ঢাকামঙ্গলবার , ৪ মার্চ ২০২৫

প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ

ধ্বংসের মুখে পরিবেশ, সচেতনতার নতুন উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
মার্চ ৪, ২০২৫ ৩:৪৮ অপরাহ্ণ । ৭ জন

প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ এক ভয়ংকর সংকটে পরিণত হয়েছে। এগুলো শত শত বছরেও মাটিতে মিশে না গিয়ে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটায় এ সংকটের প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তবে এখানেই সচেতনতার এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম খোকন। যিনি স্থানীয়ভাবে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জনের প্রচারে নিরলসভাবে কাজ করছেন।

প্লাস্টিকের টুকরোগুলো যখন নদীতে পড়ে; তখন তা মাছের খাদ্যে পরিণত হয়। এই মাছ মানুষের খাদ্য হয়ে আবার শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিক) মানুষের রক্তে প্রবেশ করছে, যা ক্যানসারসহ নানা রোগের কারণ হতে পারে। পৃথিবীর বাতাস, পানি ও মাটি আজ ভয়াবহ দূষণের শিকার। শিল্পায়ন, নগরায়ন ও মানুষের অসচেতনতা এই দূষণকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

ভুক্তভোগীরা যা বলেন
বরগুনার পাথরঘাটার জেলে আব্দুর রহিম (৫০) বলেন, ‘আগে নদীতে মাছের খুব অভাব ছিল না। এখন প্লাস্টিক আর পলিথিনে নদী ভরে গেছে। জাল ফেললেই মাছের বদলে এসব বর্জ্য উঠে আসে। এগুলোর কারণে মাছও মরছে, আমাদেরও ক্ষতি হচ্ছে।’

স্থানীয় কৃষক আমির হোসেন (৪৫) বলেন, ‘আমাদের জমিতে আগের মতো ফসল হয় না। বাজারের পলিথিন মাটিতে মিশে গিয়ে জমির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে। মাটিতে পানি আটকে যাচ্ছে, শিকড় ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারছে না।’

পাথরঘাটা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যপ্রধান এলাকা। এখানকার নদ-নদী এবং সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি মূলত মৎস্য শিকার ও কৃষির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের কারণে এখানকার বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে।

পরিবেশকর্মী আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই কিভাবে পলিথিন নদীতে পড়ে মাছের জন্য বিপদ তৈরি করছে। প্লাস্টিক ভেঙে ছোট ছোট টুকরোয় পরিণত হয়, যা মাছ খেয়ে ফেলে। এই দূষণ রোধ না করলে ভবিষ্যতে উপকূলের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে।

শফিকুল ইসলাম খোকনের উদ্যোগ
শফিকুল ইসলাম খোকন একজন পরিবেশপ্রেমী ব্যক্তি, যিনি প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে সচেতনতা তৈরি করছেন। তিনি নিজ উদ্যোগে পাথরঘাটার বিভিন্ন হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ ও নদীপাড়ের জেলেদের মধ্যে গিয়ে প্লাস্টিক বর্জনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। নিজের পোশাকের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাপড়ের ব্যাগ ও পাটের ব্যাগ ব্যবহারে উৎসাহিত করেন।

শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘মানুষ সচেতন হলেই প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব। আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি, যাতে মানুষ বুঝতে পারে প্লাস্টিক আমাদের কী ক্ষতি করছে। যদি সবাই সচেতন হয়, তাহলে পলিথিনমুক্ত পরিবেশ গড়া সম্ভব। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পেইন এবং প্লাস্টিকমুক্ত পাথরঘাটা গড়তে নিয়মিত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি।’

প্লাস্টিক দূষণ রোধে করণীয়
পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে হবে। পাট, কাপড়, ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লাস্টিক বর্জন নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালাতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের জন্য পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে।

প্লাস্টিক দূষণ শুধু একক কোনো এলাকার সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বরগুনার পাথরঘাটার মতো এলাকাগুলোয় এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতে আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। শফিকুল ইসলাম খোকনের মতো সচেতন মানুষদের পাশে দাঁড়ালে এবং সবাই মিলে প্লাস্টিকমুক্ত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুললে হয়তো আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারবো।