ঢাকারবিবার , ১৯ নভেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

নবান্ন উৎসবের ইতিকথা

রতন মণ্ডল
নভেম্বর ১৯, ২০২৩ ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ । ৫৩৪ জন

নবান্ন মানে আগ্রায়ণ মাসে আমন ধান কাটা শুরুর উৎসব। কার্তিক মাসের অভাব ঘুচিয়ে পেটপুরে নতুন চালের ভাত খাওয়ার স্বপ্ন। হেমন্তু ঋতুর অগ্রহায়ণ মাসের ১ তারিখে সাধরণত অনুষ্ঠান হয়। তবে কেউ কেউ প্রথম সপ্তাহে শুভ দিন দেখে এ উৎসব পালন করে। এ মাসে সোনার রঙে এ পাকা ধান দেখে খুশি হন কৃষক। এরপর কৃষক সে ধান কেটে গোলায় তোলেন। রেখে দেন সারা বছর খাওয়ার জন্য। নতুন এ ধান ঘরে তোলা উপলক্ষ্যে কৃষকের পরিবারে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।

উৎসবে নতুন ধানের খই, নতুন চালের আটার মলিদা বা মক্কিদ (চালের আটা, কলা গুড় দুধ নানা ফলের কুচি কুচি টুকরো পানির মিশ্রণ), চিড়া, দই, ক্ষীর, নতুন চালের ভাত, পায়েস আর সাথে শীতকালীন নতুন নতুন শাকসবজি হরেক রান্না করা হয়। নতুন চালের ভাত সাথে নয় প্রকার তরকারি রান্না করার প্রচলন আছে।

এসব খাবার শুধু মানুষেরাই খায় তা নয়, মক্কিত বা মলিদা পশুপাখিদের, পিপড়া এমনকি বাড়ির আশপাশের ফলমূলের গাছদের দেয়া হয়। রাতে নতুন চালের ভাত ও নতুন শাকসবজি রান্না হলে গরু-বাছুরকে তা খাওয়ানো হয়, কুকুরকে খেতে দেয়া হয়। আর শিয়াল পন্ডিতকে বাড়ির বাইরে খেতে দিয়ে আহবান জানানো হয়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে খেক-শিয়াল- ওকি ওঁ– প্যাক-প্যাক-প্যাক করে ডাকলে বড়রা আমাদের বলত শিয়াল নাকি বলছে “মামার ধান পাক পাক। কারণ ধান পাকলে তারা নবান্ন করতে পারবে। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় সব খাবার বাস্তুদেবকে (গৃহ বা বংশের অধিদেবতা) দেয়া হয়। একটা ঘর লেপাপোঁছা করে বাস্তুদেবকে খাবার দিয়ে কিছুক্ষণ ঘরের দরজা বন্ধ রাখা হয়।

এখনে লক্ষণীয় দর্শনগত বিষয় হলো, কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল সকল প্রকার প্রাণীকুলকে ও গৃহদেবতাকে উৎসর্গ করেই গ্রহণ করে। তাদের মানবীয় গুণের প্রকাশ। এখানে ধর্মীয়গ্রন্থগত প্রথা পালিত হয় না। এটা সম্পূর্ণভাবে আবহমান বাঙ্গালার চিরাচরিত প্রথা! ফলে আমাদের এলাকায় সকল ধর্মের মানুষেরা এই নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে!

অগ্রহায়ণ মাসে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ উৎসব হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলায় আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে ধানচাষ শুরু হয়েছিল! ধানের সঙ্গে বঙ্গবাসীর সহস্র পুরুষের আত্মিক যোগাযোগ, মিশে আছে অস্তিত্বে। বাংলায় নবোপলীয় যুগে কৃষিকর্ম শুরু থেকে ধানই শীর্ষস্থান অধিকার করে। এক কালে আমন ধানই বাংলাদেশে ধানকে বোঝানো হতো। কিন্তু ১৯৬৮-১৯৬৯ সাল থেকে দেশে ‘বোরো’ প্রজাতির ধানের চাষ শুরু হয়। এখন দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ চাষকৃত ধানই বোরো প্রজাতির। ঘরে তোলা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। মূলত ফলন ভালো ও লাভ বেশি হওয়াতেই বোরো চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এ ধানের চাষে রোগবালাই বেশি ও সার বেশি দিতে হয়। খরচও বেশি হয়।

অন্যদিকে আমন ধানের ফলন তুলনামূলক বোরোর চেয়ে কম হলেও আমন ধানের রোগবালাই কম এবং সার কীটনাশক কম ব্যবহার করতে হয়। ফলে পরিবেশ প্রকৃতির জন্যেও ভালো। তাছাড়া ধানের ভাত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। এ চালের পিঠা-পায়েসও তাই স্বাদের হয়ে থাকে। সে জন্য গ্রামবাংলায় পিঠা-পায়েস মানেই আমন ধান। অনেক কৃষক নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে নবান্ন পালন করে আসছে। এখনো জয়পুরহাটে বিশেষ করে আক্কেলপুর, কালাই ক্ষেতলাল উপজেলায় এ উৎসব পালন করে আসছে।

এখনে লক্ষণীয় দর্শনগত বিষয় হলো, কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল সকল প্রকার প্রাণীকুলকে ও গৃহদেবতাকে উৎসর্গ করেই গ্রহণ করে। তাদের মানবীয় গুনের প্রকাশ। এখানে ধর্মীয়গ্রন্থগত প্রথা পালিত হয় না। এটা সম্পূর্ণভাবে আবহমান বাঙ্গালার চিরাচরিত প্রথা! ফলে আমাদের এলাকায় সকল ধর্মের মানুষেরা এই নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে!

সবাইকে নবান্নের শুভেচ্ছা!