ঢাকাশনিবার , ২ নভেম্বর ২০২৪
  • অন্যান্য

আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্রতিবন্ধী অটোরিকশা চালকদের দাবী বাস্তবায়নে ১৭ দফা দাবী

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ২, ২০২৪ ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ । ২৩ জন

বর্তমান সময়ে প্রতিবন্ধী নাগরীকরা কর্মসংস্থানের দিক থেকে বেশ অবহেলিত অবস্থায় দিন যাপন করছে। তারপরে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে কিছু প্রতিবন্ধী মানুষ বিভিন্নভাবে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা উপার্যনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে রিকসা চালনা পেশাকে। এই রিকসার মধ্যে অটোরিকসা চালিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষেরা জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে রাস্তায় অটোরিকসা চালানোও প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কঠি হয়ে পরছে।

এই পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে গত (৩০ অক্টোবর ২০২৪) বুধবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে গণমুক্তি মঞ্চ, জাগরন প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা এবং বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) কর্তৃক আয়োজিত ‘ছাত্র জনতার অঙ্গীকার- নিরাপদ সড়ক হোক সবার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে “আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় সড়ক পরিবহনে রিকশা বিতর্ক ও করনীয়” শীর্ষক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিবন্ধী রিকশা শ্রমিক এবং তাদের সংগঠনসমুহ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠনসমুহসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

গণমুক্তি মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক জনাব সাকিব প্রত্যয় এবং বি-স্ক্যান ও পিএনএসপি’র সাধারণ সম্পাদক জনাব সালমা মাহবুবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাগরন প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি জনাব সোহেল রানা। সভায় সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বুয়েট এর সহযোগি অধ্যাপক ড. শাহনেওয়াজ হাসনাত-ই- রাব্বি এবং টাইগার নিউ এনার্জি কো. লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জয়নাল আবেদিন জয়।

এদেশের দরিদ্র জনগণের একটি সহজ এবং কারো ক্ষেত্রে স্বল্প পুজির স্বাধীন পেশা হতে পারে অটো রিকশা চালনা। অনেক মধ্য বা উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা এ পেশায় নিয়যিত হচ্ছেন। এদেশের অনেক সুশীল সমাজকে তা বন্ধ করার লক্ষ্যে তোরজোর করতেও দেখা যায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে হাইকোর্ট থেকে রায় দেওয়া হয়েছিল, ইজিবাইক অবৈধ। অপসারণ করতে হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, রিট করেছেন একটি নতুন ইজিবাইক কোম্পানির সভাপতি। এ কোম্পানি আবার ৩০ হাজার নতুন ইজিবাইক নামাবে রাস্তায়। আবার অন্যদিকে ২০২২ সালের এপ্রিলে আদালত আরেকটি রায় দিয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, আমদানি বৈধ, কিন্তু ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে পারবে না, চলতে পারবে শহরের মধ্যে, অলিগলিতে। এই রিট করলেন আমদানিকারকদের একটি অংশ। এত সব বৈধ-অবৈধর আইনি মারপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে খেটেখাওয়া ৫০ লাখ ইজিবাইক চালককে চোরের মতো রাস্তায় গাড়ি বের করতে হয়।

গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের হঠাৎ করে ঢাকার মূল সড়কে অটোরিকশা বন্ধ করে দেওয়া হয়, এতে করে রিকশা শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার ফলশ্রুতিতে সারা ঢাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে যাত্রী ও রিকশা চালক উভয়েই ক্ষতির মধ্যে পড়ে। সরকার রিকশাকে আইনানুযায়ী নিয়মের মধ্যে আনলেই ওরাও বেপরোয়া গতিতে চালাবে না। ওদের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাও দিতে হবে না। ভাড়াও অনেক কমবে।

মুক্ত আলোচনা পর্বে উপস্থিতির পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তিগণ তাদের মতামত তুলে ধরেন। কেরানীগঞ্জ থেকে মনির বলেন, লিথিয়াম ব্যাটারির দাম কমাতে হবে, এটি এখন পর্যন্ত আমাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। জাকির হোসেন বলেন, সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রশাসন কর্তৃক বাধার সৃষ্টি না হতে হয়। ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর শানজিদা আক্তার বলেন, নিবন্ধন শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী মানুষদেরকেই দেওয়া উচিৎ। অন্যান্য ব্যক্তিরা পায়ে চালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। কেরানীগঞ্জ থেকে রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ঢাকাতে রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, ঠেলা গাড়ি, ভ্যান যেস্থানে চলে, সেখানে প্রতিবন্ধী রিকশা চালকদের অনুমতি দেওয়া জরুরী। হাবিব বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষদের যাতে কোন প্রকার হয়রানি করা না হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

প্যাডেল রিকশা চালক সামসুদ্দীন বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ভিক্ষা পরিহার করে কর্ম করে খেতে চান। বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ন্যায় একটি সুরক্ষা কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। ট্রাফিক পুলিশরা আমাদের ভাই, আপনারা চাঁদাবাজির পরিবর্তে সহযোগিতা করবেন। শ্রমিক নেতা শাহ আলম বলেন, রিকশা চালকরা কোন শ্রেনীর মধ্যে পরে তা খুজে বের করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত রিকশা চালকগণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে না আসবেন, ততদিন তারা শ্রমিক হিসেবে অধিকার পাবে না। পরিবেশের পাশাপাশি রিকশা চালকদের জীবনের নিরাপত্তা অধিকতর গুরত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পরিবেশ বান্ধব ব্যাটারি তৈরি করা। কোন রিক্সা শ্রমিক ঋণ নিয়ে রিকশা কিনবে না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব তাদের কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করা। শ্রম তহবিল হতে প্রতিবন্ধী রিকশা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জাগরণ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সদস্য হানিফ বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষদের সুবর্ণ কার্ড ছাড়া আর কিছুই পাইনি ৮৫০ টাকা ভাতায় আমাদের কিছুই হয়না। পুলিশ আমাদের রিকশা আটকে দেয়, বাজে ভাষায় গালাগালি করে। তারা গলির ভেতরে চালাতে বলে। অন্যান্য রিকশা চলতে পারলে আমরা কেন পারবো না। আমরা যে যা কাজ পারি তা করার সুযোগ প্রদান করতে হবে।

বি-স্ক্যানের পরিচালক ইফতেখার মাহমুদ বলেন, আমাদের আন্দোলনে রিকশা শ্রমিকরাও আমাদের সাথে ছিলেন। ন্যায্যতার ভিত্তিতে ধনীদের স্বার্থ বিবেচনা না করে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সকলের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত হবে। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি হলেও যত মাথাব্যথা রিকশা শ্রমিকদের নিয়ে। যারা নিবন্ধন প্রাপ্ত হবেন তাদের সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে হবে। আমরা কোন ব্যবসায়ী নয়, জনসাধারণের রাষ্ট্র দেখতে চাই। আমাদের আগামী দিনের জন্য নিজেদের প্রস্তত থাকতে হবে।

নিউ টাইগার এনার্জি এর মো জয়নাল আবেদিন জয় বলেন, অটো রিকশা নিয়ে সরকারের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। চার্জিং, চুরি সমস্যায় আমরা কাজ করে আসছি, ব্যাটারির ভ্যাট ট্যাক্স ছাড় দিতে হবে তাহলে এর দাম কমানো যাবে। ট্রায়াল বেসিসে ১০০টা চার্জিং পয়েন্ট করেছি, দিন প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে। আগামী বছর আমরা ১০০০ স্টেশন করবো। ট্রাফিক পুলিশ এখন ডিউটি করতে পারছে না। তারা চাঁদাবাজি করায় এখন তাদের কথা কেউ শোনেনা। সকলের সদিচ্ছা থাকলে আমরা আমাদের চাহিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।

এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বুয়েট এর সহযোগি অধ্যাপক ড. শাহনেওয়াজ হাসনাত-ই- রাব্বি বলেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী অটো রিকশার অনুমোদন দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী রিকশা চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সড়ক পরিবহনে রিকশার ব্যবহার বিষয়ে ১৭ দফা সুপারিশনামা:

১। অটো রিকশাতে সীসা ব্যাটারি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে লিথিয়াম ব্যাটারি বাধ্যতামূলক করা।
২। রিকশার সুনির্দিষ্ট ডিজাইন বিআরটিএ থেকে অনুমোদন দেয়া।
৩। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডের জনঘনত্বের ভিত্তিতে রিকশার নিবন্ধন দেয়া।
৪। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ১০% প্রতিবন্ধী চালককে কোটা দেয়া।
৫। প্রতিটি রিকশার নম্বর প্লেট দেয়া এবং তাদের আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক বাহনের মতো শাস্তির বিধান করা।
৬। পেট্রোল পাম্পের মতো সরকারি অনুমোদনে এলাকাভিত্তিক চার্জিং স্টেশন তৈরি করা।
৭। রিকশা চালকদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্যে এনে রিকশা চালনার জন্য অনুমোদন কার্ড সরবরাহ করা।
৮। অসচ্ছল রিকশা চালকদেরকে সহজ কিস্তিতে অটো রিকশা ক্রয় করার সুযোগ দেয়া।
৯। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে লিথিয়াম ব্যাটারি আমদানিতে আগামী দশ বছরের জন্য শুল্ক ছাড় দেয়া।
১০। অটো রিক্সা, সাইকেলসহ অন্যান্য ধীরগতির যানের চলাচলের জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে পর্যায়ক্রমে পৃথক লেন চালু করা।
১১। সার্ভিস সড়কে গ্রাউন্ডেড ইউলুপ/ ইউটার্ন করে রিকশা চলাচল করতে দেয়া।
১২। অনুমোদনহীন রিকশা চালালে দন্ড, আর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা।
১৩। সকল সাইকেল রিকশাকে অটো রিকশা (লিথিয়াম ব্যাটারি) দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।
১৪। ২০৩০ সালের মধ্যে সকল ক্ষেত্রে সীসা ব্যাটারি নিষিদ্ধ করা।
১৫। সড়কে রাজনৈতিক ও পেশীশক্তির ব্যবহারে চাঁদাবাজি বন্ধ করা।
১৬। বিকল্প কর্মসংস্থান বা পূনর্বাসনের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধ না করা।
১৭। উপর্যুক্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন হবার আগে প্রতিবন্ধী অটোরিকশা চালকদেরকে প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ এবং বিশেষ ক্ষেত্রে সার্ভিস সড়ক ক্রস বা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া