সকালের মিষ্টি বাতাসে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা হাতে বসে আছে রফিক। প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু না করলে তার মন ভালো থাকে না। শুধু রফিক নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দিনের শুরুতে চা পান করাকে এক অপরিহার্য অভ্যাস হিসেবে গড়ে তুলেছে। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোন দেশে মাথাপিছু চা পান সবচেয়ে বেশি হয়।
বিশ্বজুড়ে চা পান: কোন দেশ এগিয়ে?
তালিকার শীর্ষে রয়েছে তুরস্ক, যেখানে একজন নাগরিক গড়ে বছরে ৩.১৬ কেজি চা পান করেন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আয়ারল্যান্ড (২.৩৬ কেজি) এবং তৃতীয় স্থানে যুক্তরাজ্য (১.৮২ কেজি)। চা উৎপাদনে অন্যতম প্রধান দেশ ভারত রয়েছে তালিকার ২৯তম স্থানে, যেখানে জনপ্রতি চা পান মাত্র ০.৩৩ কেজি।
এশিয়ার বড় দেশগুলোর মধ্যে চীন রয়েছে ২১তম স্থানে (০.৫৭ কেজি), মালয়েশিয়া ২৩তম স্থানে (০.৪৮ কেজি) এবং ইন্দোনেশিয়া ২৪তম স্থানে (০.৪৬ কেজি)। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু চা পান মাত্র ০.২৩ কেজি, যা এই তালিকার ৩৬তম স্থানে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের চা শিল্প: সমস্যা ও সম্ভাবনা
এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। অথচ, বাংলাদেশে চা শুধু একটি পানীয় নয়, বরং প্রতিটি আড্ডা, ব্যবসায়িক আলোচনার টেবিল কিংবা পরিবারের একান্ত সময়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবুও মাথাপিছু চা পানের হিসাবে বাংলাদেশ পেছনে পড়ে আছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা থাকলেও এখনো রপ্তানিনির্ভর নীতির কারণে অনেকাংশ চা বিদেশে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশের চা শিল্পের সম্ভাবনা বিশাল। সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পঞ্চগড়ের চা বাগানগুলো প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ চা উৎপাদন করে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, শ্রমিকদের কম মজুরি এবং বাজারজাতকরণ সমস্যার কারণে বাংলাদেশ এখনো বিশ্ব চা বাজারে বড় অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা দিন দিন বাড়লেও গুণগত মানসম্পন্ন চা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
চা শিল্পের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস বহু পুরনো। ব্রিটিশ শাসনামলে সিলেট অঞ্চলে চা চাষের সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে এটি একটি অন্যতম অর্থকরী শিল্পে পরিণত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬০টির বেশি চা বাগান রয়েছে এবং প্রতি বছর প্রায় ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর একটি বড় অংশ রপ্তানি করা হয়।
চা শ্রমিকদের জীবনমান ও চ্যালেঞ্জ
চা শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো চা শ্রমিকরা। তবে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের জীবনমান খুবই নিম্নমানের। তারা সাধারণত দৈনিক মাত্র ১২০-১৫০ টাকা মজুরি পান, যা তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে এই শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি চায়ের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ যদি চা শিল্পে গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে এটি দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত হতে পারে। পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ বাজারে মানসম্মত ও সাশ্রয়ী মূল্যের চা সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে দেশীয় চায়ের জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও করণীয়
চা শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে সরকার এবং ব্যবসায়ীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং নতুন চায়ের ভ্যারাইটি উৎপাদনের মাধ্যমে এই খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
রফিকের মতো লাখো মানুষ প্রতিদিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করে। তবে একদিন হয়তো বাংলাদেশও মাথাপিছু চা পানের তালিকায় উঁচু স্থানে উঠে আসবে, যদি দেশের চা শিল্পের সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়।