ঢাকাশনিবার , ১৮ নভেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

বাতিল করুন ভুল ধারণা

মানুষ কি তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে?

পাবলিকহেলথ ডেস্ক
নভেম্বর ১৮, ২০২৩ ৫:৫০ অপরাহ্ণ । ৩৯৭ জন

‘মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহার করে’— এমন কথা শোনেননি বা বলেননি, আমাদের মধ্যে এমন মানুষ খুব কমই আছেন। কিন্তু এ কথাটা কতটুকু সত্য?

২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া সায়েন্স-ফিকশন সিনেমা ‘লুসি’-তেও বিখ্যাত অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যানকে বলতে দেখা যায়— ‘মানুষ গড়ে মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকে। যদি তারা শতভাগ মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারত, তাহলে বিশ্বে আকর্ষণীয় জিনিস ঘটতে শুরু করত।’

মস্তিষ্কের মাত্র ১০ ভাগ ব্যবহারের এই প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম।  এমন কথা খুব শুনতে পাওয়া যায় যে আইনস্টাইন তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এর সাথে এমনটাও বলা হয় যে আমরা যদি কেউ মস্তিষ্কের ব্যবহার বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষেও আইনস্টাইনের মতো বড় বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব।

আইনস্টাইন মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন?

শোনা যায় যে আইনস্টাইন এক সাক্ষাৎকারে জনৈক সাংবাদিককে বলেছিলেন, তিনি তাঁর মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছেন। কিন্তু আইনস্টাইনের এ বক্তব্যের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইনের আর্কাইভ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, তাঁদের কাছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। অর্থাৎ আইনস্টাইনের নামে কেউ মিথটা চালু করেছিল।

এমনটাও বাজারে চালু আছে যে বিজ্ঞানীরা আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক গবেষণা করে দেখেছেন, সেটা বিশেষ রকমের। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের সাথে তাঁর মস্তিষ্কের কোনো মিল নেই। এটাও একটা গুজব ছাড়া কিছু নয়।

এমন ভুল কথা চালু হলো কীভাবে?

অনেকে গবেষক মনে করেন, ধারণাটির সূত্রপাত হয়েছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামে ভুল উদ্ধৃতি থেকে অথবা ১৭ শতকে ফরাসি মনোবিজ্ঞানী পিয়েরে ফ্লোরেন্সের কাজের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে।

আমেরিকান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমসের ১৯০৮ সালে প্রকাশিত এক বই থেকেও এমন ধারণার সূত্রপাত হতে পারে। তিনি তাঁর ‘দ্য এনার্জিস অব ম্যান’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘আমরা আমাদের সম্ভাব্য মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতার অল্প কিছু অংশমাত্র ব্যবহার করি।’

অথবা আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী কার্ল ল্যাশলির কাজ থেকেও এ ধারণার সূত্ৰপাত হতে পারে। ল্যাশলি ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি বড় অংশ সরিয়ে নেন। তারপরও তিনি দেখেন, ইঁদুরগুলো বিশেষ কিছু কাজ করতে পারছে।

তবে যেভাবেই এই ধারণার উৎপত্তি হোক না কেন, পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক তথ্যসূত্র ছাড়াই এই ধারণা প্রচার করে এসেছে।

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে। যেমন দেখা, শোনা, পড়া, ঘ্রাণ নেওয়া ইত্যাদি শনাক্ত ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য মস্তিষ্কের আলাদা অংশ রয়েছে। শরীরজুড়ে বিস্তৃত নিউরনের জাল বৈদ্যুতিক সংকেত মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়, আবার মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশ বয়ে আনে। এ প্রক্রিয়া চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

ধারণাটি কেন ভুল

১. মস্তিষ্কের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকলে, কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মস্তিষ্কের কোনো অংশের সামান্য ক্ষতিতেও মানুষের বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়।

২. মস্তিষ্কের আধুনিক স্ক্যান পদ্ধতিতে দেখা গেছে, মস্তিষ্ক সবসময় সক্রিয় থাকে। তবে কিছু অংশ হয়তো কখনো অন্য অংশের চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এমনকী ঘুমের মধ্যেও মানুষের মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে।

৩. অক্সিজেন ও শক্তি খরচের দিক থেকে মস্তিষ্ক মানবশরীরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অঙ্গ। এটি শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ শক্তি খরচ করে, যদিও ওজন সমগ্র শরীরের মাত্র ২ শতাংশ। যদি এ রকম একটি অঙ্গের শতকরা ৯০ ভাগই অকেজো থাকত, তাহলে বিবর্তনের ধারায় মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয় অংশগুলো অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাদ হয়ে যেত। নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ বলছে, বিবর্তনের শুরুর দিকে শিশুর বড় মস্তিষ্কের কারণে প্রসবের সময় বহু মায়ের ও নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। ৯০ শতাংশ অপ্রয়োজনীয় হলে বিবর্তনীয় ধারায় মানুষের মস্তিষ্ক হতো আকারে আরও ছোট।

৪. মস্তিষ্কের প্রতিটি অংশেরই আলাদা কাজ রয়েছে। পুরো মস্তিষ্ক এককভাবে কাজ না করে, বরং প্রতিটি অংশ একটি জটিল প্রক্রিয়ায় সমষ্টিগতভাবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে এমন কোনো অঞ্চল পাওয়া যায়নি, যার কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই।

৫. সিঙ্গেল ইউনিট রেকর্ডিং ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে ক্ষুদ্র ইলেকট্রোড প্রবেশ করিয়ে প্রতিটি নিউরন পর্যবেক্ষণ করেন। যদি শতকরা ৯০ ভাগ নিউরন নিষ্ক্রিয় থাকত, তাহলে সেটি এই রেকর্ডিংয়ে ধরা পড়ার কথা।

৬. অব্যবহৃত থাকলে মস্তিষ্কের কোষের অবক্ষয়ের প্রবণতা রয়েছে। যদি শতকরা ৯০ ভাগ নিউরন কোষই অকার্যকর থাকত, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের অটোপসিতে বিশাল পরিসরে অবক্ষয় পরিলক্ষিত হতো।

সিদ্ধান্ত

এ ধারণার জন্ম যেভাবেই বা যখনই হোক, এর যে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তা বিভিন্ন গবেষণায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।