প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পাহাড়ের ঢালুতে আবাদ করা জুমের ধান কাটার উৎসব চলছে। মুখে হাসি নিয়ে এসব ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত জুমিয়ারা। সম্প্রতি থানচি বলিপাড়া এলাকায় দেখা যায়, অধিকাংশ উঁচু নিচু পাহাড় জুড়ে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে সোনালী রঙের পাকা ধান। পাশাপাশি রয়েছে মরিচ, ভুট্টা, চিনাল, মারফা ও কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল। আর এসব ফসল এখন ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জুমচাষিরা।
সেখানে কমলা বাগান পাড়ার বাসিন্দা ও জুমচাষি মিলন ত্রিপুরা তিনি বলেন, পরিবারসহ ১৫ জন নারী-পুরুষের সমন্বয়ে জুমের পাকা ধান কাটছেন। ধান কাটতে কাটতে মিলন ত্রিপুরা জানান, এবছর ১২ আড়ি জায়গায় (এক আড়িতে ১০ কেজি) ১২ আড়ি ধানের জুম করতে পেরেছেন। প্রাকৃতিক কারণে ফলন কম হলেও সন্তুষ্ট তিনি।
তিনি বলেন, আগে রোদ-বৃষ্টি হলে জুমের ধান ভালো হতো, এখন সময় মতো রোদ-বৃষ্টি হয় না। প্রকৃতিও উল্টো হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ আগের মতো ভালো থাকলে অন্তত ৩০০ আড়ি ধান পেতাম। এবারে ২০০ আড়ি ধান পাবো বলে আশা করছি।
ধান কাটার উপযুক্ত সময়ে টানা ৪-৫ দিন বৃষ্টি হওয়ায় অনেকের পাকা ধান নষ্ট হয়েছে। এতে করে আগামী বছর খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা করছেন জুমচাষি মিলন ত্রিপুরা।
শ্রমের বিনিময়ে শ্রম নীতিতে কাজ করা পুষ্পরানী ত্রিপুরা জানান, তারাও জুম চাষ করেছেন। কিন্তু তাদের জুমের ধান এখনো কাটার উপযুক্ত হয়নি। তাই প্রতিবেশীর পাকা ধান কাটতে সহযোগিতা করছেন তিনি। কিছুদিন পর তাদের ধান কাটার উপযুক্ত হলে, তাদের থেকেও শ্রম দিয়ে জুমের ধান কাটার সহযোগিতা পাবেন।
প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করা হয়। আর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জুম চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় জঙ্গল কাটা হয়। তারপর কাটা জঙ্গল রোদে শুকানোর পর মার্চ-এপ্রিল মাসে জঙ্গলে আগুন দিতে প্রথমে ফায়ারিং লাইন করে জঙ্গল পোড়ানো হয়। এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে ধান বপনের জন্য প্রস্তুত করে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা চলে।
বৃষ্টি হলেই জুমের জায়গায় ধানসহ সাথী ফসল বপন করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সাথী ফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। আর যারা একটু দেরিতে বপন করেন তাদের ধান দেরিতেই পাকে।
প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বান্দরবান জেলায় ২০২১ সালে জুম আবাদ হয়েছিল ৮ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জায়গায়। আর উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৪৬৭ দশমিক ২২ টন চাল। ২০২২ সালে আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ২৯২ হেক্টর জায়গায়। আর উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৪১৮ দশমিক ১২ টন চাল। ২০২৩ সালে জুম আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জায়গায়। আর উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৪৮৯ দশমিক ৭১ টন চাল।
চলতি বছর ২০২৪ সালে জুম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৪৬০ হেক্টর জায়গা। আবাদ অর্জনে ৮ হাজার ২৬৭ হেক্টর, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৭১ টন চাল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. হাসান আলী জানান, বান্দরবানে চলতি বছর প্রায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জায়গায় জুমের আবাদ হয়েছে। জুমে ধান ছাড়াও সাথীফসল হিসেবে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। এবছর জুমের ফলন ভালো হবে বলে আশা করা যায়। তবে পার্বত্য অঞ্চল হওয়ার কারণে বৃষ্টি সব জায়গায় সমানভাবে হয়নি। যার কারণে উৎপাদনে তারতম্য হয়। একেক জায়গার ফলন একেক রকম হয়ে থাকে।