রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বড় ধরনের দুর্বলতা আছে। যে দুর্বলতার সু্যোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো। হাজার হাজার কোটি টাকা কর বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। ব্যাহত হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো কর্মসূচি।
এনবিআরের এসব দুর্বলতা তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক আছে।
প্রথমত, বিভিন্ন কমিশনারেটে চলমান মামলাগুলোতে এনবিআরের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। কারণ কেন্দ্রীয়ভাবে মামলা পরিচালনা ও মনিটরিং এর কোনো ব্যবস্থা রাজস্ব বোর্ডে নেই। ফলে কমিশনারেটগুলোতে মামলা পরিচালনায় নানা অনিয়ম হয়। অনেক সময় অসাধু কর্মকর্তারা প্রতিপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হন। মামলা পরিচালনায় তারা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে নিজের ও কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করেন।
দ্বিতীয়ত, এনবিআরের কর্মকর্তারা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলি হন। সাধারণত দুই থেকে আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে সাধারণত বড় মামলা নিষ্পত্তি হয় না। মামলা দায়েরকারী কর্মকর্তা বদলি হলে অনেক সময় পরিচালনার গতি কমে যায়। মামলা দায়েরকারী কর্মকর্তা যতটা আন্তরিক থাকেন পরবর্তী কর্মকর্তারা ততটা থাকেন না। আবার মামলাজটও এতে প্রভাব বিস্তার করে।
তৃতীয়ত, এনবিআর কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব। রাজস্ব সংক্রান্ত আইন এনবিআর প্রণয়ন করে ঠিকই। কিন্তু এনবিআরের অনেক কর্মকর্তা আইনে দক্ষ ও পারদর্শী হতে পারেন না। অন্যদিকে বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের হিসাব বিভাগে অত্যন্ত মেধাবী হিসাববিদদের নিয়োগ দেন। আবার মামলা পরিচালনায় প্রভাবশালী আইনজীবীদের দারস্থ হন।
এসব দুর্বলতার প্রমাণ সম্প্রতি কিছু ঘটনায় পাওয়া গেছে। ভ্যাট আদায়ের সবচেয়ে বড় কমিশনারেট এলটিইউয়ে বেশকিছু অনিয়ম ধরা পড়েছে। অনেকগুলো কোম্পানিকে বেআইনিভাবে মামলা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবির দুইটি মামলা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। একটি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বিকল্প উপায়ে অর্থাৎ এডিআরে। ১৫৭ কোটি টাকার মামলাটিতে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে এলটিইউ। সরকার কোনো রাজস্ব পায়নি। খালাস পেয়েছে কোম্পানি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কমিশনার পদে থাকা অবস্থায় এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। কমিশনার বদলি হলে বিষয়টি জানাজানি হয় এবং এনবিআরের নজরে আসে। প্রাথমিক ও চূড়ান্ত তদন্তে এনবিআর অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। সেই ১৫৭ কোটি টাকা আদায়ে ব্যবস্থা নিতে এলটিইউকে নির্দেশ দেয় এনবিআর।
একই বহুজাতিক কোম্পানির ২০৫৪ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির একটি মামলা নিষ্পত্তিতে অনিয়মের আশ্রয় নেন তৎকালীন কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা বিদায় নিলে অনিয়ম সম্পর্কে জানতে পারে এনবিআর। তদন্ত করে সত্যতাও মেলে। এই টাকা আদায়েও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা লাগবে। বর্তমানে যে আইন আছে তা দিয়ে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ সম্ভব নয়। অন্যদিকে এনবিআরের হাতে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব দেয়া হলে সেটি হবে প্রহসন।
প্রথমত, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা বাংলাদেশে কর আদায়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খাত। এখাত থেকে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সরকার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। এ খাতের কর আদায় ধারাবাহিকভাবে উর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ সরকারের জন্য এটা সোনার ডিম দেয়া হাঁস। সোনার ডিম দেয়ার হাঁস এ কারণে যে, রাজস্ব আদায়ে অন্য খাতগুলোর পারফরমেন্স তামাক খাতের মতো নয়। বহুচেষ্টায়ও এনবিআর রাজস্ব আয় বাড়াতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, ধূমপান নিরুৎসাহিত করার অজুহাতে এনবিআর প্রতিবছরে সিগারেটে কর বাড়ায়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে। আমি এমন কোনো রিপোর্ট দেখিনি যে, বাংলাদেশে আশাব্যাঞ্জক হারে ধূমপায়ী কমছে। কিংবা তামাক ও সিগারেট উৎপাদন কমেছে। উলটো তামাক কোম্পানিগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। কারণ সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে কোম্পানিগুলোর মুনাফা তুলনামূলকভাবে বাড়ে। ফলে সিগারেটের দাম বাড়ার ফল হচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলোকে শক্তিশালী করা।
তৃতীয়ত, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে একদিকে তামাক ও সিগারেট উৎপাদন কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে সিগারেটের দাম অব্যাহতভাবে সব স্তরে বাড়াতে হবে। অবাধ উৎপাদনের সুযোগ রেখে শুধু দাম বাড়িয়ে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ সম্ভব নয়। এনবিআরের মাধ্যমে সিগারেট কোম্পানিগুলোকে প্রতিবছর উৎপাদন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিতে হবে। একই সাথে দাম বাড়িয়ে সিগারেট দুর্লভ করতে হবে। এবং রাজস্ব আদায়ও ঠিক থাকবে। অন্যথায় তামাকমুক্ত বাংলাদেশ সম্ভব নয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী