ঢাকাসোমবার , ১১ নভেম্বর ২০২৪

শিশুর যখন ডেঙ্গু

প্রফেসর ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লা
নভেম্বর ১১, ২০২৪ ১:১৭ অপরাহ্ণ । ৬৫ জন

এখন এ দেশে সবচেয়ে আলোচিত আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। এটা ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। প্রবেশ করার ৪ থেকে ১০ দিন পর রোগের উপসর্গ দেখা যায়।

ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি টাইপের যেকোনো একটি দিয়ে ডেঙ্গু রোগ হয়ে থাকে। মানব শরীরে প্রবেশের পর এ ভাইরাস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে রক্তনালি, লিভার এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেমে (রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা)। রক্তনালি থেকে প্রচুর জলীয় অংশ/প্লাজমা রক্তনালির বাইরে চলে আসে। ফলে রক্তের পরিমাণ ও রক্তচাপ কমে যায়। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, বিশেষ করে ব্রেন, কিডনি, লিভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। লিভারে প্রদাহের দরুন সেখান থেকে নিঃসৃত রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের ঘাটতি পড়ে। এ ছাড়া রক্তের ভেতর রক্ত জমাট বাঁধার আরেকটা প্রয়োজনীয় উপাদান প্লাটিলেটের ঘাটতি পড়ে যায়। এসব কিছুর সামগ্রিক প্রভাবে আক্রান্ত শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে।

নাড়ির গতি, রক্তচাপ কমে শকে চলে যেতে পারে, যা জীবনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শরীরের বিভিন্ন জয়গা থেকে রক্তপাত হতে পারে। রক্তনালি থেকে বের হয়ে আসা প্লাজমা/পানি ফুসফুস, পেটসহ শরীরের বিভিন্ন জয়গায় জমে যায়। রক্তচাপ কমে গিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে এবং মাল্টি–অরগান ফেইলিউর হতে পারে।

ডেঙ্গু রোগের প্যাথলজি এবং তার উপসর্গ অনেকটা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো হলেও শিশুরা অল্প সময়ের মধ্যেই রোগের জটিলতা এবং ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এটা তাদের নাজুক শারীরিক গড়ন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার কম ক্ষমতা বা জটিলতার ঝুঁকি সামলানোর অপরিপক্বতার জন্যই হয়ে থাকে।

রোগের লক্ষণ

সাধারণভাবে, আক্রান্ত শিশুদের লক্ষণ বড়দের মতোই।

১. জ্বর, যা প্রায় ১ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত থাকে। প্রচণ্ড ক্ষুধামন্দা ও বমি বমি ভাব।

২. অনেক সময় শরীরে র​্যাশ হয়। তবে এবারের ডেঙ্গু জ্বরে র​্যাশ কম।

৩. মাথা বা শরীরের ব্যথায় বাচ্চা অযথা কান্নাকাটি বা বিরক্ত করতে থাকে।

৪. কখনো কখনো বমি, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে।

৫. অনেক সময় শরীরের বিভিন্ন জয়গায় রক্তপাতের চিহ্ন দেখা যায়, যেমন মাড়ি বা নাক থেকে।

৬. অনেক সময় পেট ফুলে যায়, বাচ্চার কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

৭. কিশোরী মেয়েদের মাসিকের সময় বেশি রক্তপাত হতে পারে।

৮. মনে রাখা দরকার, জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। তাই জ্বর কমে গেলেও শিশুর প্রতি নজর দিতে হবে।

অভিভাবকদের করণীয়

অন্য আর পাঁচটা কারণে জ্বর হলে তার জন্য যা যা করা দরকার, ডেঙ্গু হলেও তা–ই করতে হবে। যেমন নির্দিষ্ট মাত্রায় প্যারাসিটামল দেওয়া, হালকা গরম পানিতে শরীর মুছে দেওয়া, বেশি বেশি তরল খাবার দেওয়া ইত্যাদি।

সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে যেসব বিষয়ে—

১. তরল খাবার, পানি, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি বেশি করে পান করাতে হবে মুখে যত পারা যায়।

২. প্রস্রাব যথেষ্ট ও ঠিকমতো করছে কি না, খেয়াল রাখুন। ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ভালো।

৩. নিয়মিতভাবে নাড়ির গতি, রক্তচাপ মাপা জরুরি। তাই কাছের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন।

৪. বর্তমান মৌসুমে শিশুর জ্বর শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এবং তাঁর নির্দেশে রক্তে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, এসএস ওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাবেন। কোনো বাচ্চার জ্বর ৫-৬ দিন পার হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাবেন।

৫. হাত-পায়ের তাপমাত্রা কত, তা খেয়াল করবেন।

৬. জ্বর কমে যাওয়ার পর মানে ষষ্ঠ দিন থেকে নিশ্চিন্ত না হয়ে আরও সতর্ক হতে হবে।

৭. প্রতি মুহূর্তেই নিচে লেখা বিপদচিহ্নগুলো খেয়াল করবেন এবং তা পেলে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে নিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাবেন।

বিপদচিহ্ন কী?

১. বাচ্চা মুখে কিছুই খেতে পারছে না

২. যা খাচ্ছে তা–ই বমি করছে

৩. বাচ্চা কেমন যেন অস্থির কিংবা নিস্তেজ, প্রাণচাঞ্চল্য নেই

৪. পেটে ব্যথা

৫. ৬-৭ ঘণ্টা প্রস্রাব হচ্ছে না

৬. শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হচ্ছে, যেমন চামড়ায় নিচে রক্ত জমলে, দাঁতের মাড়ি, নাক থেকে, বমির সঙ্গে ইত্যাদি। পায়খানা কিন্তু প্রতিবারই খেয়াল করতে হবে, কারণ কালচে পায়খানা রক্তক্ষরণের একটা লক্ষণ।

৭. বাচ্চার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা

৮. শ্বাসকষ্ট বা পেট ফোলা

শিশুদের সুরক্ষা দিন

এ সময় শিশুদের মশার কামড় থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। ফুলহাতা জামা–প্যান্ট পরান, মোজা পরান। দিনের বেলায়ও মশারি দেবেন ঘুমালে। বাড়িকে মশামুক্ত রাখুন। স্কুলে বা বাইরে যাওয়ার সময় ত্বকে মশা নিরোধক ক্রিম লাগান। বাড়িতে কারও ডেঙ্গু হলে তাকে সর্বক্ষণ মশারির ভেতর রেখে যত্ন নিন, যাতে রোগ ছড়াতে না পারে।

নোট: শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লার লিখিত ‘শিশু স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাঁর অনুমতিক্রমে।