আমরা যারা অবস-গাইনির প্র্যাকটিস করি, তারা রোগী দেখতে বসলে আজকাল প্রায়ই এক ধরনের রোগী পাই, যাদের মূল অভিযোগ থাকে হঠাৎ করে মুটিয়ে যাওয়া, মাসিক অনিয়মিত হয়ে যাওয়া, মুখে অবাঞ্ছিত লোমের আধিক্যসহ আর কিছু সমস্যা। এদের বয়স সাধারণত ১২-৫০ বা যাকে আমরা বলি প্রজননক্ষম বয়স তার মাঝে থাকে। ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা, জৈব-রাসায়নিক পরীক্ষা এবং আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের ভিত্তিতে যে রোগ অবশেষে নির্ণীত হয় তা হচ্ছে, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা পিসিওএস। সারা পৃথিবীতে ৮-১৩ শতাংশ মহিলা এ রোগে ভুগছে। আমাদের দেশের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ নারী এ রোগে আক্রান্ত। ভয়ের কথা হচ্ছে এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম আসলে একটি বহুমুখী রোগ। তার মানে এ রোগে শরীরের অনেকগুলো সিস্টেম একত্রে বা ভিন্ন ভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়। যেমন হরমোনাল সিস্টেম, জেনেটিক সিস্টেম, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এমনকি আচরণগত কারণও এ রোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
উপসর্গ
রোগের উপসর্গ সবার এক রকম না। তবে সাধারণ উপসর্গ হচ্ছে:
• মাসিকের সমস্যা, মাসিক অতিরিক্ত বা অল্প পরিমাণে হওয়া, অনেক দিন পর পর হওয়া বা অনেক দিন বন্ধ থাকা
• চুল পড়ে যাওয়া, এমনকি টাক হয়ে যাওয়া
• হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া
• মুখে ব্রণ ওঠা
• মুখে অবাঞ্ছিত লোম গজানো
• খুব ঘন ঘন মেজাজের তারতম্য হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অবসাদে ভোগা ইত্যাদি
রোগ নির্ণয়
রোগীর ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা, রক্তে বিভিন্ন হরমোনের পরিমাণ, (রক্তে সুগারের মাত্রা জানতে ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা ওজিটিটি করা হয়) জিটিটি, লিপিড প্রোফাইল, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
ঝুঁকি
সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না করলে এ রোগ থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন:
• বন্ধ্যাত্ব
• ঘন ঘন গর্ভপাত
• হৃদরোগ
• টাইপ ২ ডায়াবেটিস
• স্তন ক্যান্সার
• জরায়ু ঝিল্লির ক্যান্সার ইত্যাদি
চিকিৎসা
এ রোগ নিরাময়যোগ্য নয়। তবে চিকিৎসার মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হচ্ছে:
• শরীরের ওজন ঠিক রাখা
• মাসিক নিয়ন্ত্রণ করা
• হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা
• দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যাগুলো প্রতিহত করা
• ব্রণ, অবাঞ্ছিত লোমের চিকিৎসা করা
চিকিৎসা পদ্ধতি
প্রতি রোগীর জন্য তার রোগের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। যার মধ্যে আছে:
• জীবনযাত্রার ধরন বদলানো
• মেডিকেল চিকিৎসা
• শল্য চিকিৎসা এবং
• অন্যান্য বিশেষ চিকিৎসা
এর ভেতর মেডিকেল, শল্য ও বিশেষ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক দেবেন। বদলাতে হবে জীবনযাত্রার ধরন।
কী করবেন, আর কী করবেন না
অতিরিক্ত ওজন ঝরাতে হবে। এতে আপনার প্রজনন ও হরমোনসংক্রান্ত সমস্যা অনেকখানি কেটে যাবে। এজন্য খাবার নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম, পরিমিত ঘুম আর চাপমুক্ত থাকতে হবে।
খাবার
• দিনে মোট তিনবার খাবেন। মাঝখানে একবার হালকা নাশতা চলতে পারে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর আর কিছু খাবেন না। শুধু পানি ও দুধ চিনি ছাড়া চা চলতে পারে।
• খাবারে শর্করা ও আমিষের ভারসাম্য আনতে হবে। শর্করার পরিমাণ কমাতে হবে এবং আমিষ বাড়াতে হবে। ওজন যত কেজি তত গ্রাম প্রোটিন প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকা জরুরি। খাবারের তালিকায় অঙ্কুরিত শস্য ও আস্ত শস্য রাখতে হবে। প্রক্রিয়াজাত শর্করা যেমন সাদা চাল, সাদা ময়দা খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আইসক্রিম, চিপস, পিৎজা, বিস্কিট, কনফেকশনারিজাত খাবার তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলতে হবে। অর্গানিক খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন।
• প্রচুর পানি, ফলের রস খেতে হবে
• চা, কফি, মদপান ছাড়তে হবে
• মিষ্টি খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে
ব্যায়াম
নিয়মিত সঠিক ব্যায়াম ওজন কমাতে ও শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া বাড়াতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচদিন ব্যায়াম করা উচিত।
ঘুম
প্রতি রাতে ৭ ঘণ্টা ভালো ঘুম হওয়া জরুরি। রাত ১১টা বাজার আগে শুয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুন। সম্ভব হলে বিছানায় যাওয়ার আগে হালকা গরম পানিতে একবার গোসল করে নিন। ঘুমাতে যাওয়ার ২ ঘণ্টা আগে থেকে সব রকম ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেট ব্যবহার বন্ধ রাখুন।
মানসিক চাপমুক্ত থাকা
মানসিক চাপে থাকলে শরীর থেকে যে হরমোন বের হয় তা পিসিওএসের অবস্থা আরো খারাপ করে দেয়। সুতরাং চাপমুক্ত থাকতে হবে। এজন্য:
• প্রিয়জন বা বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো
• মাঝে মাঝে ঘুরতে বা বেড়াতে যাওয়া
• প্রকৃতির মাঝে বেশি সময় কাটানো
• বাগান করা
• ধ্যান বা প্রার্থনা
• যে কাজে আনন্দ পাওয়া যায় তাতে নিজেকে নিয়োজিত রাখা
কথায় বলে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা শ্রেয়। কথাটি এ রোগের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সত্য। আর এক্ষেত্রে একমাত্র নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই আপনাকে দিতে পারে সেই আরাধ্য ফলাফল। তাই নিজেকে ও পরিবারকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও সুরক্ষিত রাখার জন্য রোগাক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক হন, জীবনযাপনে সংযমী হোন।