ঢাকামঙ্গলবার , ৮ অক্টোবর ২০২৪
  • অন্যান্য

সুন্দরবনে বাঘ বেড়ে ১২৫, এই জরিপের খরচ ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক
অক্টোবর ৮, ২০২৪ ১২:০৭ অপরাহ্ণ । ২৭ জন

বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী বাঘ। সুন্দরবনে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। বর্তমানে সেখানে ১১টি বাঘ বেড়ে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৫। এবার বাঘ জরিপে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। জরিপে ২১টি বাঘের শাবকের ছবি পাওয়া গেছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মাত্র পাঁচটি বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গিয়েছিল। এ তথ্য জানিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

আজ (৮ অক্টোবর) মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘সুন্দরবন বাঘ জরিপ ২০২৪’-এর ফল ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী। আইইউসিএন কর্তৃক বাঘকে বাংলাদেশে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১০ সালে ১৩টি টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রির মধ্যে বর্তমানে ১০ টি দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, রাশিয়া, চীন থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাঘ রয়েছে। অবশিষ্ট ৩টি দেশ অর্থাৎ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বনাঞ্চল হতে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩৮৪০টি।

বাঘ জরীপের মাধ্যমে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ, বনে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি বাঘ সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ পূর্বক বাঘ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য সর্বপ্রথম ২০১৫ সালে আধুনিক পদ্ধতি ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে বাঘ জরীপ করা হয় এবং উক্ত জরীপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬ টি এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২.১৭। ২০১৮ সালে ২য় পর্যায়ে ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে সুন্দরবনের বাঘ জরীপে ১১৪টি বাঘ পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ছিল ২.৫৫। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাঘ বৃদ্ধি পায় ৮টি এবং বাঘ বৃদ্ধির শতকরা হার ছিল প্রায় ৮ শতাংশ।

বন বিভাগ সূত্র আরও জানায়, সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে ৩য় পর্যায়ে বাঘ জরীপ সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে শেষ হয়। উক্ত বাঘ জরীপে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা, খুলনা, চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জে চারটি ব্লকে ৬০৫টি গ্রীডে স্বয়ংক্রীয় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রতিটি গ্রীডে বাঘের গতিপথ, বিচরণ, অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সাথে ০২টি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ৬০৫টি গ্রীডে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার ২১০টি ক্যামেরা মোট ৩১৮ দিন রেখে দেয়া হয় এবং ৩৬৮টি গ্রীডের ক্যামেরায় বাঘের ছবি পাওয়া যায়। ১০ লক্ষাধিক ছবি ও ভিডিও থেকে শুধুমাত্র বাঘের ছবি পাওয়া যায় ৭ হাজার ২৯৭টি। এত বিপুল সংখ্যক বাঘের ছবি ইতঃপূর্বে পাওয়া যায়নি। ক্যামেরা ট্র্যাপিং এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রীয়ভাবে বাঘের ছবি তোলার মূল উদ্দেশ্য হলো বাঘের দেহে যে ডোরাকাটা দাগ আছে তা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা। বাঘের ডোরাকাটা দাগ ও দেহের বিভিন্ন অংশের ছবি বিশ্লেষণ করে একক ও অনন্য বাঘের ছবি সনাক্ত করা হয়।

জরীপকালে প্রাপ্ত বাঘের ছবি ও অন্যান্য তথ্য উপাত্তসমূহ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পে নিয়োজিত বাঘ বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক বিশ্লেষণ ও যাচাই বাছাই করে বাঘের সংখ্যা ও বাঘের ঘনত্ব নিরূপণ করা হয়। এছাড়া জরীপের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর ভারত, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মতামত গ্রহণ করা হয়। সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে ২০২৩-২০২৪ সালে সুন্দরবনে পরিচালিত বাঘ জরীপে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া যায় এবং প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটার বনে বাঘের ঘনত্ব পাওয়া যায় ২.৬৪। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৫ সালের তুলনায় বাঘের সংখ্যা ১৭.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া ২০২৩-২৪ সালের বাঘজরীপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া যায়। তবে বাঘ শাবকের সংখ্যা জরীপের ফলাফলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়না। কারণ ছোট থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বাঘ শাবকের মৃত্যুর হার অনেক বেশী হয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ সালের বাঘজরীপে ২১টি বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে ২০১৫ ও ২০১৮ সালের বাঘজরীপে মাত্র ০৫টি করে বাঘ শাবকের ছবি পাওয়া গিয়েছিল।

বন বিভাগ জানায়, বাঘ সংরক্ষণে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বাঘসহ সুন্দরবনের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননের উদ্দ্যেশে বনের ৫৩.৫২ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সেখান থেকে সকল ধরণের বনজ বাঘ মানুষের দ্বন্দ্ব হ্রাসে লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাইলনের ফেন্সিং তৈরি করা হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের ভিতরে ১২টি মাটির উঁচু কিল্লা/ডিবি নির্মাণ করা হয়েছে। বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা এবং গুরুতর আহত ব্যক্তিকে ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করা হচ্ছে।

বাঘ সংক্রান্ত অপরাধ উদ্ঘাটনে তথ্য প্রদানকারীকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সম্মানি প্রদান করা হচ্ছে। লোকালয়ে চলে আসা বাঘকে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেবার জন্য স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে এবং টিমের সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্ব বাঘ দিবস পালনসহ বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।

ক্যামেরা ট্রাপিংএর মাধ্যমে বাঘ জরীপে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৮ সাল এবং ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশের সকলের জন্য আনন্দদায়ক ও তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ। বাঘ যেহেতু অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং বাঘের জন্য এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, সেহেতু বাঘ সংরক্ষণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় জনগণ, ছাত্র-ছাত্রী, যুবসমাজ, সংবাদিকসহ সামাজের বিভিন্ন স্তরের সহযোগিতা আন্তরিকভাবে কাম্য।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন-সহ অন্যান্য অতিরিক্ত সচিববৃন্দ, বন অধিপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমএ আজিজ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রমুখ।