ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

স্থানীয় সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

হাজার বিঘা জমির জলাবদ্ধতা দূর হলো যেভাবে

হারুন অর রশিদ
সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩ ৮:০০ পূর্বাহ্ণ । ২৪৩ জন

খাল বিল নদী বেষ্টিত উত্তর জনপদের প্রসিদ্ধ জেলা রংপুর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ জেলাটির অর্থনীতি পুরোপুরি কৃষি নির্ভর। বছরজুড়ে নানা ফসলে ভরে থাকে এখানকার মাঠঘাট। তবে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পূর্বে অবস্থিত পাঁচগাছি ইউনিয়নের ভূমির গঠন অপেক্ষাকৃত নিচু হওয়ায় বেশিরভাগ জমিতে বছরে দুবার ধান চাষ হয়ে থাকে। বিল অধ্যূষিত এলাকা হওয়ায় গ্রামের মানুষ দুই মৌসুমে ধানের কাজের বাইরে বাকি সময়টা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

নানা কারণে পিছিয়ে থাকা এলাকাটির উচ্চশিক্ষার হারও শোচনীয়। এবং যেকোনো সংকটে একজোট হবার নজিরও উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সম্প্রতি নিজেদের দাবি আদায়ে তাদের একত্রিত আন্দোলন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে।

মূল ঘটনায় প্রবেশের আগে বলে নিই, আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাঁচগাছি ইউনিয়নের একতা বাজার এলাকায়। পড়াশোনা ও কাজের সূত্রে এলাকায় না থাকলেও নিয়মিত খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। এরই অংশ হিসেবে আমার সম্পৃক্ততা।

যাহোক। পহেলা সেপ্টেম্বর রাতের স্থানীয় যুবক রাজু মণ্ডলের ফেইসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানতে পারি, ১৫-২০ দিন ধরে এলাকার বামনি, ভেকি ও ভেলামারি বিলের হাজার হাজার বিঘা ধানি জমি পানিতে ডুবে রয়েছে। জানামাত্রই ভেতরে অস্বস্তি তৈরি হয়। এই ভেবে যে, একটা কৃষি নির্ভর এলাকার সবটুকু ফসল নষ্ট হলে, তাদের মুখে কে খাবার দেবে!

যদিও আগে থেকে জানতাম, বিলগুলোর পানি প্রবাহের জন্য যে নালা ও ছোট কালভার্ট আছে, সেগুলোর মুখ ভরাট করা হয়েছে। নালার বিপরীত পাশে স্থানীয় প্রভাবশালী ও আওয়ামী লীগ নেতার পুকুর এবং কালভার্টের মুখ ভরাট করে যাদের জমি, সেই পরিবারে বাবার পর ছেলে গ্রাম পুলিশ সদস্যেরর দায়িত্ব পালন করছে। সম্প্রতি তারা সেখানে বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে। মাঝের অনাবৃষ্টিতে ভবিষ্যতে কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই দূরদর্শী চিন্তাটা হয়তো কারও মধ্যে সেভাবে কাজ করেনি। কারণ শেষ বছরগুলোতে বৃষ্টিহীনতায় পুরো এলাকা পানি শূন্যতায় ভোগে। তবে গত মধ্য আগস্টে অতিবৃষ্টির প্রভাবে সৃষ্টি হয় তীব্র জলাবদ্ধতা। ডুবে যায় তিন বিলের কয়েক হাজার বিঘা জমির ধান। যা এলাকাটির প্রধান অর্থকরী ফসল।

এই কদিনে এলাকাবাসী ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, পানি প্রবাহ বন্ধকারী এবং প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। কিন্তু তাদের শত চেষ্টাও যেন বিফলে যাচ্ছিলো। ঠিক সেসময় কোনো পথ না পাওয়া এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে ২ সেপ্টেম্বর
মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে রাজু মণ্ডল, আতাউর রহমান প্রমূখ। যারা জানান দেয়, নিজেদের দাবি নিজেদের আদায় করে নিতে হয়। যা প্রচার হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। অবশ্য সেদিনই উপজেলা প্রশাসন চেষ্টা করেও পানি নিষ্কাশনে হয়। না পারে নালার মুখ খুলে দিতে, না পারে বছরের পর বছর ধরে পানি প্রভাবের বিকল্প পথ সেই কালভার্ট উন্মুক্ত করতে।

ওই দিন দুপুরে আমি যোগাযোগ করি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে। কথা বলে ঘটনার জটিলতা আঁচ করতে সহজ হয়। এক পর্যায়ে যোগাযোগ করি, রংপুরের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। যদিও আগে থেকে ঘটনা জানতেন, তারপরও নিজের পরিচয় দিয়ে সমস্যার বিষয়ে জানাই। অনুরোধ করি, দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে। কথার শেষে, এলাকার একজন হিসেবে জেলা প্রশাসক আমার কাছেই পরামর্শ চান কী করা যেতে পারে। এক ধরনের দায়িত্ব দেন, সবার মতামত জেনে জানাতে।

প্রথমেই যোগাযোগ করলাম, সেই গ্রাম পুলিশ সদস্যের সাথে। প্রায় ২০ মিনিট কথা বলে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত না পেয়ে সেই রাজু মণ্ডলকে বলি, ওর বাড়ি গিয়ে কথা বলতে। তাদের কথার ভিত্তিতে পুনরায় ডিসিকে জানাই, গ্রাম পুলিশ সদস্যের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে প্রাথমিকভাবে পানি প্রবাহের পাইপ বসানো এবং দ্রুত স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে। এই ফাঁকে তিনি সংশ্লিষ্ট আসনের সাংসদ ও স্পীকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাংসদ নির্দেশ দেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার।

পরদিন, ৩ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন দ্বিতীয় দিনের মতো ঘটনাস্থলে যায়। অনেক বোঝানো সত্ত্বেও গ্রাম পুলিশ সদস্যের পরিবার জায়গা না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। চেষ্টা চলে বিকল্প পথ সন্ধানের। ঠিক সেই সময় নিরুপায় কৃষকদের অনুরোধ ও প্রশাসনের আশ্বাসে জুয়েল ভাই সম্মতি দেন তার বসতভিটার মাঝ দিয়ে পাইপ বসানোর।

মুহূর্তেই সবার মাঝে স্বস্তি ফেরে। সম্ভব হয় প্রাথমিকভাবে কৃষকের ফসল বাঁচানোর ব্যবস্থা করার উদ্যোগ। সফল হয় অজোপাড়াগাঁয়ের শত মানুষের একজোট হওয়ার প্রচেষ্টা। অবশ্য, জেলা প্রশাসকের আন্তরিকতা, সমস্যার বিষয়ে শোনার আগ্রহ এবং সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার মানসিকতায় আমি বিস্মিত হয়েছি। অতল শ্রদ্ধা তার প্রতি। সঙ্গে সংবাদকর্মী হয়ে নিজ এলাকার জন্য সামান্য কিছু করতে পারাটা প্রশান্তি বাড়িয়েছে।

যদিও নালার মুখ দ্রুত উন্মুক্ত না করার বিষয়টি বিষাদের। হয়তো প্রভাবশালীদের বাধার কারণে সেটি হয়নি। তবে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, নালার মুখ উন্মুক্তকরণের পাশাপাশি স্থায়ী ব্যবস্থা করানোর। প্রত্যাশা করছি, আগামীতেও সকল সংকট মোকাবিলায় আমার জন্মভিটার, সুধা মাটির গন্ধে বেড়ে ওঠা এলাকাবাসী ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী