ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৪ জানুয়ারি ২০২৪
  • অন্যান্য

ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার ঘটাচ্ছে স্লো-পয়জনিং

শিশুরা কী খাচ্ছে?

পাবলিক হেলথ ডেস্ক
জানুয়ারি ৪, ২০২৪ ৮:৫১ অপরাহ্ণ । ২০১ জন

২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০২২ থেকে জানা যায়, দেশে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ চরম অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছে। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত কোমল পানীয়, মাত্রাতিরিক্ত লবণ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার। এ জরিপটি করেছে ‘জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)’।

জরিপে খাদ্য-সংক্রান্ত বিষয়ে ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী দুই হাজার ৫৭৮ শিশুর তথ্য নেওয়া হয়। জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ শিশু জরিপের তথ্য সংগ্রহের আগের দিন কোমল পানীয় পান করেছে এবং ৪৯ শতাংশ শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েছে।

২০১৯ সালের রমজান মাস শুরুর আগে খোলা বাজার থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা কেনে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট বা বিএসটিআই। এরপর সেসব পণ্য বিএসটিআই-এর ল্যাবে পরীক্ষা করার পর ৫২টি পণ্য ল্যাব পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুদের চিপস, খাবার পানি, নুডলস, চানাচুর, বিস্কুট ইত্যাদি।

এসবের বাইরেও দেশে অবাধে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত ঘন চিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেট মিশ্রিত বালিশ ও ললি নামে পানি জাতীয় শিশু খাদ্য। কয়েক বছর আগে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের একটি কারখানায় গিয়ে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখতে পেয়েছিল যে কাপড়ে ব্যবহৃত রঙ, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবন মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের জুস এবং জেলি। শিশুদের জন্য বালিশ ও ললি নামের বিভিন্ন রকমের পানীয় খাদ্য তৈরিতে বেনজেট, জেনথেন, সোডিয়াম, কালার, ফ্লেভার, পানি ও চিনির পরিবর্তে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘনচিনি ব্যবহার করছেন। পানি, রঙ (কালার), ঘনচিনি, ফ্লেভার, সাইট্রিক এসিড  মেশানো হচ্ছে।

এই চিনি শরীরে প্রবেশ করলে কিডনি, লিভারসহ নানা অঙ্গ বিকল হওয়াসহ ক্যানসারে আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে। তাই সরকারিভাবে সোডিয়াম সাইক্লামেট খাবারে মেশানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর এ কারণে সরকার আমদানিও বন্ধ করেছে। ঘন চিনি অনেকটা বোতলজাত সাইট্রিক অ্যাসিডের মতো। তাই আমদানিতে সাইট্রিক অ্যাসিড হিসাবে দেশে আসছে। কিছু চিপস কারখানার মালিক বিভিন্ন স্থানে অতি গোপনে মেশিন বসিয়ে তৈরি করছে এ সকল পানি-জাতীয় শিশু খাদ্য।

ভেজালের আগ্রাসনে শিশুরা পরিপাকের সমস্যা তৈরি হয়। ক্ষুদা ও খাদ্য চাহিদা কমে যায়। এতে পুষ্টিহীনতা, চোখ-কানের রোগ, কিডনি ইনফেকশন ও ক্যান্সারের মত প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

জরিপে কোন ধরনের খাবারকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে ধরা হয়েছে?

কোমল পানীয় বলতে ধরা হয়েছে বাজারে বিক্রি হওয়া বিভিন্ন ধরনের কার্বোনেটেড বেভারেজ ও বিভিন্ন কোম্পানির ফলের জুস। এসব খাবারে প্রচুর প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে। চিনি জাতীয় ও অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবারের মধ্যে আমরা বার্গার, পিৎজা, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, চিপসসহ বিভিন্ন জাংক ফুড।

জরিপের শিশু কারা?

জরিপে কেন শুধু ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের তথ্য নেওয়া হয়েছে?— এমন প্র  জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছয় মাস থেকে শিশুদের মায়ের দুধের পাশাপাশি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক খাবার খেতে দেওয়া হয়। এ সময়ে যদি শিশুদের পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিত না করা যায়, তবে আর কখনোই শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে শিশুদের কী ধরনের খাবার দেওয়া হচ্ছে, তা তুলে ধরতেই এই বয়সী শিশুদের বেছে নেওয়া হয়েছে।’

এসব খাবারে মূলত যা থাকে

পাঁচটি ‘চ’ আদ্যক্ষরের খাবার এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠছে—চিপস, চানাচুর, চকলেট, চুইংগাম ও চাটনি। এছাড়া আছে নানা ধরনের কোমল পানীয়। প্রতিটি সুষম খাবারের পরিপন্থী।

শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব খাবারে পুষ্টি বলতে তেমন কিছুই নেই। অপরদিকে তা শিশু স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির। কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকায় তা গ্রহণ করায় শিশুদের ক্ষুধামন্দাও দেখা যাচ্ছে। যার ফলে শিশুদের একটি বড় অংশেরই মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

খাবারগুলো কেন অস্বাস্থ্যকর?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ইউনিসেফের ২০২১ সালের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ খাবারগুলো চরম অস্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। এসব খাবার খাওয়ার কারণে শিশুদের শৈশবকালীন স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার বা পানীয় দাঁতের ক্ষয় করে এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার শিশুদের ওজন বাড়ায়। সুষম খাবারের পরিবর্তে শিশুরা এসব খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিমাণমতো পুষ্টি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়।

এসব খাবার শিশুদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবার খেয়ে প্রতিবছর প্রায় চার লাখ ২০ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে পাঁচ বছরেরও কম বয়সি।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জন্মের প্রথম ৫ বছর শিশুর জন্য ভীষণ সংবেদনশীল। মাত্রাতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ সব বয়সীদের জন্যই ক্ষতিকারক, আর শিশু-স্বাস্থ্যের জন্য তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এসব খাবার খেলে শিশু-স্বাস্থ্যে জটিলতা প্রথমে যত না প্রকাশ পায়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমস্যাগুলো জটিলাকার ধারণ করে। এসব খাবার গ্রহণে শিশুদের কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সারও হতে পারে।

খাবারে ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, কীটনাশক ইত্যাদির কারণে শিশুর কিডনি ও লিভারসহ যেসব জায়গায় বেশি রক্ত চলাচল করে সেসব অঙ্গ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। থাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের সম্ভাবনা। এর বাইরে পেটের পীড়া, পেটে ঘা, আলসার, চর্মরোগ ইত্যাদি প্রভাব খুব বেশি দেখা যাচ্ছে।

চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, ভেজাল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের শরীরে এসব উপাদান ‘স্লো পয়জনিং’-এর মতো কাজ করছে। মূলত দুইভাবে শিশুরা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে।

এক. শিশুদের পছন্দের খাবার যেমন : জুস, চকোলেট, জেলি ইত্যাদিতে নিম্নমানের ও ভেজাল রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা।

দুই. বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফল, সবজিতে অতি মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার, মাছ বা সবজিতে ফরমালিনের ব্যবহার।

শিশুদের পেটের পীড়ার রোগের বেশিরভাগই সরাসরি ভেজাল খাদ্যের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়। খাবারে ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, কীটনাশক ইত্যাদির কারণে শিশুর কিডনি ও লিভারসহ যেসব জায়গায় বেশি রক্ত চলাচল করে সেসব অঙ্গ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে। এর বাইরে পেটের পীড়া, পেটে ঘা, আলসার, চর্মরোগ ইত্যাদির কারণও ভেজাল শিশুখাদ্য।

কোমল পানীয় যতটা বিপজ্জনক

ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া ‘কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংক স্বাস্থ্যের জন্য কতোখানি ক্ষতিকারক’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছিলেন বিএসএমএমইউ’র পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের ডা. এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া। ২০২২ সালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে উঠে এসেছিল কোমল পানীয় গ্রহণের ঝুঁকির তথ্য।

সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কোমল পানীয়তে অতিরিক্ত চিনি, ক্যাফেইন ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণার জন্য বাজার থেকে নেওয়া ২৫০ মিলিলিটারের কোমল পানীয়তে পিএইচ মাত্রা ২.৫ থেকে ৩.৪ সীমারেখা থাকলেও তাতে ২০.৮ থেকে ২৮.৮ গ্রাম পর্যন্ত চিনি পাওয়া গেছে।

গবেষণটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির ওপর নির্ভর করে করা হলেও তাতে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কোমল পানীয়তে থাকা অতিরিক্ত চিনি, ভারী ধাতু অসংক্রামক রোগের কারণ। বাংলাদেশের ৬৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও অধিকতর বিপজ্জনক হতে পারে।

ডব্লিউএইচও’র গাইডলাইন অনুযায়ী, ২৪ মাস পর্যন্ত শিশুদের বাড়তি চিনিযুক্ত খাবারের ব্যাপারে পুরোপুরি নিষেধ করা হয়েছে। একইসাথে এ বয়সী শিশুদের সোডা, চিনিযুক্ত দই, কুকিজ খাওয়ানোর বিষয়েও নিষেধ করে বলা হয়েছে, এসব খাবারে সাধারণত চিনি যোগ করা হয়।

সামান্য ২৫০ মিলিলিটার কোমল পানীয়তে যে পরিমাণ চিনি থাকে তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পুরো একদিনের চিনি গ্রহণের সমান। তাই ৬-২৩ মাস বয়সে এই পরিমাণ চিনি গ্রহণ শিশুর জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করবে। যা শিশুকে স্বেচ্ছায় একপ্রকার ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো।

 

তথ্যসূত্র :

দৈনিক প্রথম আলো (https://www.prothomalo.com/bangladesh/6hr4a30nkg)

দ্যা ডেইলি স্টার বাংলা (https://bangla.thedailystar.net/health/news-543931)

এবং অন্যান্য সংবাদপত্র