ঢাকারবিবার , ১৩ এপ্রিল ২০২৫

চড়ক পূজার উৎপত্তি, বিবর্তন এবং বাংলার ঐতিহ্য হয়ে উঠার ইতিহাস

রঞ্জন কুমার দে
এপ্রিল ১৩, ২০২৫ ৪:১৯ অপরাহ্ণ । ৩৮৬ জন

চড়ক পূজা, যা বাংলার হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, তার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত। এটি মূলত কৃষির দেবতা বা প্রকৃতির আরাধনা হিসেবে শুরু হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল কৃষকের জন্য ভালো ফলন ও সমৃদ্ধি কামনা করা। প্রাচীন হিন্দু সমাজে, কৃষিকাজ এবং মৌসুমী বৃষ্টির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীলতা থাকায়, এই পূজার মাধ্যমে প্রকৃতি ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত দেবতাদের প্রার্থনা করা হতো।

চড়ক পূজার ঐতিহ্য পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। কৃষকরা এই পূজার মাধ্যমে তাদের ফসলের ফলন, জীবিকা এবং সমৃদ্ধি কামনা করত। চড়ক পূজা এমন এক আচার যা বিশেষত বসন্ত বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মৌসুমে অনুষ্ঠিত হতো, যখন কৃষকরা নতুন ফসলের আশায় প্রাকৃতিক শক্তির কাছে প্রার্থনা করত।

বাংলার জমিদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, চড়ক পূজা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে জমিদার-প্রজা সম্পর্কের সঙ্গেও। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার পর, জমিদারি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জমিদাররা কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়ের দায়িত্ব পেয়ে যান। এর পর, চড়ক পূজা ঐতিহ্য ও ধর্মীয় উৎসবের সাথে এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হয়।

১৮০০ সালের দিকে, চড়ক পূজা মূলত জমিদারদের শোষণমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বিবর্তিত হয়ে যায়। জমিদাররা এই পূজাকে এক ধরনের শাসকশক্তির প্রদর্শন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন, যাতে কৃষকদের খাজনা শোধ করার জন্য বাধ্য করা যায়। জমিদাররা চড়ক পূজার মঞ্চে কৃষকদের শাস্তি দিতেন, যদি তারা খাজনা পরিশোধে অসমর্থ হতো। শাস্তি হিসেবে কৃষকদের বড়শিতে বেঁধে চড়ক পূজার মঞ্চে ঘোরানো হতো, যা ছিল অত্যন্ত নির্মম এবং অমানবিক।

এটি এক ধরনের শাসক-প্রজা সম্পর্কের উপকরণে পরিণত হয়, যেখানে জমিদারেরা শাসন শক্তি প্রদর্শন করতেন, এবং কৃষকরা তাদের অত্যাচারের শিকার হতো। এই সময়ের পর, চড়ক পূজা ধীরে ধীরে এক শাসনমূলক আচার হিসেবে পালিত হতে থাকে, যা বাংলার গ্রামীণ সমাজে একটি ভীতি ও শোষণমূলক ঐতিহ্য হয়ে ওঠে।

চড়ক পূজার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তার শোষণমূলক ভূমিকা। জমিদাররা এই পূজাকে শুধু ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করতেন না, বরং এটি তাদের শাসনশক্তির প্রদর্শন হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৮০০ সালের পর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদাররা খাজনা আদায়কারী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন, এবং কৃষকরা খাজনা পরিশোধ না করতে পারলে শাস্তি পেতেন। চড়ক পূজার মাধ্যমে জমিদাররা শাস্তি দিতে শুরু করেছিলেন, যা ছিল কৃষকদের জন্য এক নির্মম শাস্তিরূপ।

চড়ক পূজা তখন কৃষকদের শোষণ ও জমিদারদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের উপকরণে পরিণত হয়েছিল। প্রজারা যদি চৈত্রের ৩০ তারিখের মধ্যে তাদের খাজনা শোধ করতে না পারত, তাহলে তারা চড়ক পূজার মঞ্চে শাস্তি পেত। এই শাস্তির মধ্যে ছিল বড়শিতে বেঁধে ঘোরানো, যা কৃষকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত কষ্ট দেয়। এটা জমিদারদের এক শাসকশক্তির উপকরণ হয়ে ওঠে, যা মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করত।

জমিদারি শাসনের প্রভাব পড়ে চড়ক পূজার উপর। এটি অনেক সময় কৃষকদের জন্য এক ভয়ঙ্কর শাস্তি হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি বাংলার সমাজে এক ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে ওঠে। সাধারণত এই পূজার সময় সাংস্কৃতিক উৎসবও অনুষ্ঠিত হতো, যেমন মেলা, গান, নাচ, এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। তবে চড়ক পূজার মূল উদ্দেশ্য ছিল জমিদারদের শাসনশক্তি প্রদর্শন এবং খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া।

২০ শতকের শেষ দিকে, বিশেষত ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এবং ভারতের স্বাধীনতার পর, চড়ক পূজা তার মূল ধর্মীয় উদ্দেশ্য ফিরে পায়। তবে জমিদারি শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর, এটি আর শোষণের একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। বর্তমানে, চড়ক পূজা মূলত একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়, যেখানে কৃষকরা তাদের কৃষি দেবতার কাছে প্রার্থনা করে এবং ধর্মীয় আনন্দে মেতে ওঠে।

এছাড়া, চড়ক পূজা এখন শুধুমাত্র শারীরিক কষ্ট বা শাস্তির সাথে সম্পর্কিত না হয়ে, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে উত্সাহিত হয়ে থাকে। তবে এর ইতিহাস এখনও মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি করে, কারণ এক সময় এটি ছিল শোষণের এক ভয়ানক প্রতীক।

চড়ক পূজার ইতিহাস একটি ব্যাপক পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। এটি একসময় ছিল কৃষির সাথে সম্পর্কিত একটি ধর্মীয় আচার, কিন্তু জমিদারি শাসনব্যবস্থার সময় এটি শোষণমূলক উপকরণে পরিণত হয়। তবে আজকাল এটি একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে, যা বাংলার ঐতিহ্যকে চিরকাল মনে রেখে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পালন করা হচ্ছে।