ঢাকারবিবার , ৬ এপ্রিল ২০২৫

ছুটি কেবল বিশ্রাম নয়, এক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি

রঞ্জন কুমার দে
এপ্রিল ৬, ২০২৫ ৪:০০ অপরাহ্ণ । ২০ জন

রোদ ঝলমলে এক শনিবারে নেপালের কাঠমান্ডুর এক অচেনা অলিগলিতে ঘুরছিলেন রাহুল নামের এক পর্যটক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু অদ্ভুত এক বিষয় তাকে চমকে দিল—বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট তুলনামূলকভাবে ফাঁকা। তিনি জানতেন না সেদিন নেপালে একটি ধর্মীয় ছুটির দিন। পরদিন আরেক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে দেখলেন, সেখানেও বন্ধ সবকিছু। তখন স্থানীয় একজন হেসে বলল, “এখানে বছরে ৩৫ দিন ছুটি, ভাই! কখন কী উপলক্ষে ছুটি পড়ে বলা মুশকিল।” রাহুল তখন মনে মনে ভাবলেন, “এত ছুটি হলে কাজ হয় কখন?”

এভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে—বিশ্বের কোন দেশে সবচেয়ে বেশি সরকারি ছুটি থাকে, আর কোথায় সবচেয়ে কম? এই ছুটিগুলোর পেছনে কি কেবলই ধর্মীয় বা ঐতিহাসিক গুরুত্ব, নাকি এর সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাও জড়িত?

২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, নেপাল বছরে সবচেয়ে বেশি—৩৫ দিন—সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। এ তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (২৮) ও ইরান (২৬)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ছুটির সংখ্যা বেশি, যেমন শ্রীলঙ্কা (২৫), বাংলাদেশ (২২), ভারত (১৭) এবং পাকিস্তান (১৬)।

অন্যদিকে, বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশগুলোতে ছুটির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৬ দিন, নেদারল্যান্ডসে ৭ দিন, মেক্সিকো ও যুক্তরাজ্যে ৮ দিন, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলে ৯ দিন।
এই বৈচিত্র্যের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা বাস্তবতা।

ছুটির ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলোর প্রধান উৎস হলো—

(১) ধর্মীয় উৎসব, (২) জাতীয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস, (৩) ঐতিহাসিক ঘটনা, এবং (৪) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ।

নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোকে সমান মর্যাদায় ছুটি দেওয়া হয়। যেমন, বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন—সবই জাতীয় ছুটি। একইভাবে ভারতে হোলি, দীপাবলি, ঈদ, ক্রিসমাস, গুরু নানক জয়ন্তী সবকিছু ছুটির তালিকায় জায়গা পায়।

অপরদিকে ইউরোপ বা আমেরিকার মতো অনেক দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এক বা দুটি ধর্মকে কেন্দ্র করে ছুটি নির্ধারিত হয়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে বড়দিন ও থ্যাঙ্কসগিভিং প্রধান ছুটি হলেও মুসলিম বা ইহুদি উৎসবগুলো রাষ্ট্রীয় ছুটির অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রশ্ন জাগে—একটি দেশের সরকারি ছুটি যত বেশি, সে দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা কি তত কম?

চমকপ্রদভাবে, উত্তরটা ‘না’ হতে পারে। যেমন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ড—এই দেশগুলোতে ১৪-১৬ দিন ছুটি হলেও তারা বিশ্বের অন্যতম উৎপাদনশীল অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিত। কারণ, সেখানে কাজের সময়ের দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার মান অনেক উন্নত। অন্যদিকে ছুটি কম থাকা সত্ত্বেও, অনেক উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদনশীলতা অনেক কম থাকে—কারণ কেবল ছুটির পরিমাণই নয়, কর্মপরিবেশ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও শ্রমনীতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মঘণ্টা অনেক বেশি হলেও তারা ‘ওভারটাইম কালচার’ নিয়ে সমালোচিতও হয়। এই কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ছুটি বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

একটি সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বুঝতে হলে তার ছুটির ক্যালেন্ডার পর্যবেক্ষণ করলেই অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, কম্বোডিয়ায় ২১ দিনের ছুটির মধ্যে ৮-১০টি বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে, আবার লেবাননে একসঙ্গে মুসলিম ও খ্রিস্টান উৎসব ছুটির তালিকায়।

এটি বোঝায় যে, ছুটি শুধু বিশ্রাম বা অবকাশ নয়, বরং একটি দেশের সামাজিক সহনশীলতা, বহুত্ববাদ এবং সাংস্কৃতিক গাঁথুনির প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ছুটি রয়েছে ২২ দিন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পবিত্র আশুরা, দুর্গাপূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস ও বাংলা নববর্ষ। এটি একদিকে যেমন বহুধর্মীয় উৎসবের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায়, অন্যদিকে জাতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতিকে গুরুত্ব দেয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে—বাংলাদেশে ছুটি কি বেশি, না কম? তুলনামূলকভাবে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি মাঝামাঝি পর্যায়ে। কিন্তু বর্তমানে ছুটি পুনর্বিন্যাস ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ছুটি ও ছুটির দিনে কাজের জন্য প্রণোদনা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

বিশ্বের বহু দেশেই এখন ‘হাইব্রিড ওয়ার্ক কালচার’, ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স’ এবং ‘মেন্টাল হেলথ ডে’—এই ধারণাগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কর্মজীবনে নমনীয়তা বাড়ছে। এর ফলে অনেক দেশেই স্থায়ী সরকারি ছুটির সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছুটি নেওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ, কানাডা বা ইউরোপের অনেক দেশে কর্মীদের বছরে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘পেইড লিভ’ নেওয়ার অধিকার রয়েছে, যেগুলো সরকারি ছুটি হিসেবে ধরা হয় না, তবে কর্মীরা ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী তা ব্যবহার করতে পারে।

তাই আমরা বলতে পারি ছুটি কেবলমাত্র বিশ্রামের দিন নয়, এটি একটি দেশের ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। যে দেশে বেশি ছুটি, তার মানেই নয় যে সেখানে অলসতা বেশি; আবার কম ছুটির দেশ মানেই নয় যে সেখানকার মানুষ সর্বক্ষণ ব্যস্ত। বরং ছুটির ব্যবস্থাপনা, কার্যকর প্রয়োগ এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যই আসল।

রাহুলের মতো অনেক পর্যটক হয়তো ভবিষ্যতেও হঠাৎ করেই ছুটির দিনে দোকানপাট বন্ধ দেখে অবাক হবেন। কিন্তু তখন যদি তারা একটু থেমে চারপাশের উৎসব, ধর্মীয় আয়োজন, কিংবা ঐতিহাসিক স্মরণ দেখে বোঝেন কেন ছুটি, তাহলে সেটাই হবে প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা—আর ছুটিও হয়ে উঠবে শিখন আর উপলব্ধির দিন।