ঢাকাশনিবার , ৫ এপ্রিল ২০২৫

জ্ঞানের অমৃতধারা: প্রাচীন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গল্প

রঞ্জন কুমার দে
এপ্রিল ৫, ২০২৫ ১:৪৭ অপরাহ্ণ । ১৬ জন

সন্ধ্যার শেষ আলোয় যখন নালন্দার ধ্বংসাবশেষ সোনালি আভায় মুড়ে যায়, তখন রাহুল নামের এক তরুণ গবেষক হাতে নিলেন এক প্রাচীন পান্ডুলিপি। সেখানে লেখা ছিল: “যেখানে জ্ঞানের আলো, সেখানেই সভ্যতার উষা।” এই কথাগুলো তাকে নিয়ে গেল সেই স্বর্ণযুগে, যখন ভারতবর্ষ ছিল বিশ্বজ্ঞানের তীর্থস্থান – যেখানে তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশিলা, ওদন্তপুরী, বল্লভী, নাগার্জুনকোন্ডা, শারদা পীঠ, সোমপুরা, বিক্রমপুর, জগদ্দলা ও পুষ্পগিরির মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিল।

প্রাচীন তক্ষশীলার কথা মনে হলে প্রথমেই চোখে ভাসে চাণক্যের ছবি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে শিক্ষা দিয়েছিলেন সাম্রাজ্য শাসনের কৌশল। কিন্তু তক্ষশীলা শুধু রাজনীতির শিক্ষা দিত না। এখানে চরক শিখিয়েছিলেন শল্যচিকিৎসা, পাণিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন ভাষার গঠন, আর বরাহমিহিরের জ্যোতিষ গণনা করত নক্ষত্রের গতি। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, “এখানে পারস্য, ব্যাবিলন ও চীন থেকে আসে জ্ঞানপিপাসুরা।”

নালন্দা ছিল এক বিস্ময়কর জ্ঞাননগরী। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছেন, “এখানে প্রবেশের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে এত কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় যে, দশজনের মধ্যে মাত্র একজন উত্তীর্ণ হতে পারে।” নালন্দার রত্নসাগর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল নয় তলাজুড়ে অসংখ্য পুঁথি। কথিত আছে, বখতিয়ার খিলজি যখন এটি পুড়িয়ে দেন, তখন ছয় মাস ধরে বইগুলো জ্বলেছিল।
বিক্রমশিলায় বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধারার পাশাপাশি শেখানো হত ধাতুবিদ্যার গূঢ় রহস্য। এখানে একটি বিশেষ কক্ষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হত বিভিন্ন ধাতু নিয়ে। তিব্বতি ইতিহাসে উল্লেখ আছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করতেন বিশেষ ধাতব মিশ্রণ।

ওদন্তপুরী ছিল মগধের গৌরব। পাল রাজারা এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছিলেন যে এখানে প্রতিদিন শতাধিক ভাষায় আলোচনা হতো। বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর এখানেই শিক্ষালাভ করেছিলেন, পরে যিনি তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে যান।

বল্লভী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব ছিল তার জ্যোতিষশাস্ত্রের পাঠ। গুজরাটের এই বিদ্যাপীঠে আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য নির্মিত হয়েছিল বিশাল মিনার, যার কিছু অংশ আজও দাঁড়িয়ে আছে।

নাগার্জুনকোন্ডা ছিল দক্ষিণ ভারতের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ছিলেন মহান দার্শনিক নাগার্জুন। এখানে শুধু দর্শন নয়, চিকিৎসাবিদ্যা ও স্থাপত্যকলাও শেখানো হতো।

কাশ্মীরের শারদা পীঠ ছিল সংস্কৃত শিক্ষার সর্বোচ্চ কেন্দ্র। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত ছিল হাজারো প্রাচীন পান্ডুলিপি। কথিত আছে, এখানকার পণ্ডিতরা এমন সূক্ষ্ম হস্তলিপি তৈরি করতেন যে একটি চালের দানার উপর লিখে ফেলতে পারতেন সম্পূর্ণ একটি শ্লোক।

সোমপুরা মহাবিহার ছিল স্থাপত্যের অদ্বিতীয় নিদর্শন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিরামিডাকার কাঠামো দেখে পরবর্তীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

বিক্রমপুর ও জগদ্দলা ছিল বাংলার গৌরব। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত নৌবিদ্যা ও সমুদ্রবিজ্ঞানের উপর। এখানকার পণ্ডিতরা তৈরি করেছিলেন সমুদ্রপথের বিস্তারিত মানচিত্র।

পুষ্পগিরি বিহারে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি চর্চা হত বিভিন্ন শিল্পকলার। এখানকার শিল্পীরা তৈরি করতেন এমন সূক্ষ্ম মূর্তি যে তাদের চোখ মনে হত যেন কথা বলছে।

যখন বিদেশি আক্রমণকারীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস করে, তখন পণ্ডিতরা তাদের মূল্যবান পুঁথিগুলো নিয়ে পালিয়ে যান নেপাল ও তিব্বতে। কথিত আছে, নালন্দার এক পণ্ডিত তাঁর জীবন দিয়ে রক্ষা করেছিলেন শেষ কয়েকটি পান্ডুলিপি।

আজ যখন আমরা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনা করি, তখন ভাবতে হবে সেই সব প্রাচীন বিদ্যাপীঠের কথা, যারা রেখে গেছে জ্ঞানের অমূল্য সম্পদ। হয়তো একদিন আবার খননকার্য চালিয়ে আমরা উদ্ধার করতে পারব এই হারানো জ্ঞানকেন্দ্রগুলোর সম্পূর্ণ ইতিহাস।