বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন—পহেলা বৈশাখ—আজ একটি ধর্মনিরপেক্ষ, রঙিন ও সর্বজনীন উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, এর শিকড় ছড়িয়ে আছে বহু পূর্বের লোকায়ত সংস্কৃতিতে। এই সংস্কৃতির অন্যতম এক ধারা হলো—তাজিয়া মিছিল। অনেকেই জানেন না, সপ্তদশ শতক থেকেই ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, তাজিয়া মিছিল কেবল ধর্মীয় শোকপ্রদর্শনের মাধ্যম ছিল না; বরং তা একধরনের ভিজ্যুয়াল ও পারফর্মেটিভ আর্টফর্মে পরিণত হয়েছিল। এই মিছিলের মোটিফ ও চিত্রভাষাই ভবিষ্যতে গড়ে তুলেছিল বৈশাখী শোভাযাত্রার রূপান্তরিত সাংস্কৃতিক কাঠামো।
তাজিয়া শব্দটি এসেছে আরবি “তাজিয়া” থেকে, যার অর্থ “শোক”। তাজিয়া মিছিল মূলত ইসলাম ধর্মের শিয়া সম্প্রদায়ের আশুরা পালনকে ঘিরে সংগঠিত হলেও উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বহু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে একধরনের “লোকজ শোকানুষ্ঠান” বা “popular performative mourning”-এ রূপ নেয়। বিশেষ করে বাংলায় এই মিছিল কেবল ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং একধরনের চাক্ষুষ নাট্যপ্রদর্শনী হিসেবেও গৃহীত হয়।
ইতিহাসবিদ রিচার্ড এম. ইটন তাঁর গ্রন্থ The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204–1760–এ উল্লেখ করেন:
“In rural Bengal, Muharram processions were widely observed by both Sunni and Shia Muslims, and frequently participated in by Hindus as well, demonstrating the cultural syncretism that characterized religious practice in the region.”— (Eaton, 1993, p. 272)
এই তাজিয়া মিছিলে দেখা যেত ইমাম হোসেনের শাহাদাতকে কেন্দ্র করে তৈরি কারুকার্যময় কাঠামো—ইমামবাড়া, যুদ্ধ প্রতীক হিসেবে ঘোড়ার (জুলজানা), তরবারি, রক্তের প্রতীকী ব্যবহার, শোকগাথা আবৃত্তি, ঢোল-নগাড়ার বাজনা এবং লোকজ সুর ও নৃত্য। এতে গড়ে উঠত একধরনের “street theatre”।
তাজিয়া মিছিলে হিন্দুদের অংশগ্রহণ ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ইতিহাসবিদ Syed Ali Nadeem Rezavi লিখেছেন:
“In cities like Lucknow, Murshidabad, and Dhaka, it was not unusual for Hindus to participate in Muharram, constructing tazias, sponsoring processions, or performing marsiyas.”— (Rezavi, in Shi‘ism in South Asia, ed. Justin Jones, 2011)
বাংলার লোকসমাজে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও মফস্বলি এলাকায়, তাজিয়া ছিল এমন একটি মেলা বা আয়োজন, যা ধর্মীয় ভেদরেখার বাইরেও সামষ্টিক চেতনাকে জাগিয়ে তুলত।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে যে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়, তাতে আমরা দেখতে পাই মুখোশ, ঘোড়া, হাতি, রঙিন কাঠামো—যা সবই মূলত “সাংস্কৃতিক প্রতীক”। এই মোটিফগুলো অনেকাংশেই বাংলার লোকজ উৎসব—যেমন তাজিয়া, চড়ক পূজা, গাজনের নাট্যরূপ ইত্যাদি থেকে ধার করা।
Dr. Perween Hasan তার গবেষণায় বলেন:
“The aesthetics of Mongol Shobhajatra draw upon a mixture of folk traditions, religious festivals and colonial-era processions—creating a secular cultural hybrid that resonates with shared memory.”— (Hasan, “Folk Traditions in Modern Bangladeshi Art”, Journal of Bengal Studies, 2010)
তাজিয়া মিছিল, যদিও ধর্মীয় অনুষঙ্গবাহী, কিন্তু তার ভিজ্যুয়াল ও পারফর্মেটিভ দিক, সামাজিক সম্প্রীতির জায়গা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ তাকে রূপ দিয়েছে একধরনের “লোকমেলায়”।
বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ‘মোটিফ’ অর্থাৎ আলঙ্কারিক বা প্রতীকী চিত্রের ব্যবহার তাজিয়া থেকেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। এটি পরবর্তীকালে বৈশাখী শোভাযাত্রায় রূপান্তরিত হয়, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-তে এর ধারাবাহিকতা স্পষ্ট।
১৯৮৯ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা যখন বের হয়, তখন চারুকলার শিক্ষার্থীরা বেছে নিয়েছিলেন এমন কিছু প্রতীক—বাঘ, মুখোশ, হাতি, সূর্য, ঘোড়া—যা গ্রামীণ চিত্রকলা, তাজিয়ার কাঠামো এবং লোকনাট্য থেকে প্রভাবিত। এই সব মোটিফের মধ্য দিয়ে তাঁরা চেয়েছিলেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভবোধ, বাঙালিত্বের গৌরব, এবং ঐক্যের বার্তা পৌঁছে দিতে। এই ধারাকে ২০১৬ সালে UNESCO “Intangible Cultural Heritage” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তাজিয়া ও পহেলা বৈশাখ উভয়ের মোটিফই একধরনের নাটকীয় প্রতিবাদ, স্মরণ ও উদযাপনের মিলনস্থল। তাজিয়ায় যেমন দেখা যায় আত্মত্যাগের স্মরণ ও শোকের ব্যঞ্জনা, তেমনই বৈশাখের শোভাযাত্রায় দেখা যায় প্রতিরোধ, আশাবাদ এবং চিরায়ত জীবনের চিত্ররূপ। দুই ক্ষেত্রেই লোকনাট্য ও ভিজ্যুয়াল আর্টের ব্যবহারে জনমানসকে উদ্বেলিত করার একটি প্রয়াস রয়েছে।
তাই তাজিয়া মিছিল কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয়, এটি বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা, যার মোটিফ আজো বেঁচে আছে অন্যরূপে—পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায়, চিত্রকলায়, মুখোশে, আর লোকনাট্যে। তাই পহেলা বৈশাখকে বুঝতে হলে, আমাদের ইতিহাস ও লোকাচারকে গভীরভাবে জানতেই হবে, বুঝতে হবে তাজিয়ার ভিজ্যুয়াল চর্চাকে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির অংশ হয়ে আছে।