ঢাকাবুধবার , ৯ এপ্রিল ২০২৫

ধোলাভিরা: মরুভূমির বুকে হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার গল্প

রঞ্জন কুমার দে
এপ্রিল ৯, ২০২৫ ২:২৫ অপরাহ্ণ । ২১ জন

ভারতের গুজরাট রাজ্যের কচ্ছ মরুভূমি—প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর প্রান্তর, যেখানে রুক্ষ বালি আর প্রখর সূর্যের মাঝে কেবল নিস্তব্ধতা। কিন্তু কল্পনা করুন, আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে, এই মরুভূমির মাঝেই গড়ে উঠেছিল এক প্রাচীন শহর—ধোলাভিরা। একে বলা হয় সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম বিস্ময়কর সৃষ্টি। ১৯৬৭ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ জগপতী যাদব এই প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তারপর থেকেই ধোলাভিরা ইতিহাস অন্বেষীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

ধোলাভিরা কচ্ছের খাদির দ্বীপে অবস্থিত, যা সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত। শহরটির সময়কাল ধরা হয় আনুমানিক ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত। গবেষণা বলছে, এটি শুধু একটি বসতির জায়গা ছিল না, বরং একটি সুপরিকল্পিত নগর, যেখানে ছিল উন্নত নগরব্যবস্থা, জল সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক বিনিময়ের সুব্যবস্থা।

এই শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তার চমৎকার নগর পরিকল্পনা। ধোলাভিরাকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল—উচ্চ শহর (দুর্গ), মধ্য শহর এবং নিম্ন শহর। প্রতিটি অংশ ছিল সুরক্ষিত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং তাদের মধ্যে সংযোগ ছিল সুপরিকল্পিত রাস্তা ও প্রবেশপথের মাধ্যমে। এই শ্রেণিবিন্যাস প্রমাণ করে, ধোলাভিরার মানুষ সমাজকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা করত।

তবে যেটি ধোলাভিরাকে সত্যিকার অর্থে ব্যতিক্রম করেছে, তা হলো এর জল সংরক্ষণের প্রাচীন কৌশল। মরুভূমির মাঝে বসতি গড়ে তোলা কখনোই সহজ নয়, কিন্তু ধোলাভিরার বাসিন্দারা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বিশাল জলাধার, পাথরের কুয়ো এবং সেচব্যবস্থা গড়ে তোলে। এমনকি আজও সেই প্রাচীন জলাধার দেখে বিস্মিত হতে হয় আধুনিক প্রযুক্তিবিদদের। প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলেন, এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম দিককার পরিকল্পিত জল সংরক্ষণ নগরসমূহের একটি।

লিখিত যোগাযোগের প্রমাণও পাওয়া গেছে ধোলাভিরায়। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে হরপ্পা লিপিতে লেখা ফলক ও প্রতীক। একটি বিশাল সাইনবোর্ড আকৃতির পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে ওই লিপিতে খোদাই করা কিছু চিহ্ন দেখা যায়। যদিও আজও এই লিপির পাঠ সম্পূর্ণরূপে উন্মোচন হয়নি, তবে এটি স্পষ্ট যে ধোলাভিরাবাসীরা যোগাযোগের জন্য এক ধরণের প্রতীকভিত্তিক ভাষা ব্যবহার করত।

ধোলাভিরার অর্থনৈতিক কাঠামোও ছিল বিস্তৃত। এখানে উৎপাদিত হতো পোড়ামাটির পাত্র, অলংকার, ধাতব যন্ত্রাংশ এবং হস্তশিল্প। আশপাশের অঞ্চল এবং দূরবর্তী অঞ্চল, এমনকি পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে দেখা গেছে।

তবে সব কিছুরই যেমন শুরু আছে, তেমনি শেষও আছে। ধোলাভিরার পতনের সুনির্দিষ্ট কারণ আজও বিতর্কিত। কেউ বলেন জলবায়ু পরিবর্তন, কেউ বলেন ভূমিকম্প, আবার কেউ মনে করেন নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে পানির সংকট সৃষ্টি হয়, যা ধোলাভিরার পতনের মূল কারণ। কিন্তু এই পতনও ধোলাভিরাকে মুছে ফেলতে পারেনি। ২০২১ সালে ইউনেসকো ধোলাভিরাকে World Heritage Site হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে এই প্রাচীন শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে তুলে ধরে।

আজ ধোলাভিরা আমাদের শেখায় কীভাবে মানুষ প্রকৃতির সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বুদ্ধিমত্তা ও সংগঠনের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে। আধুনিক নগরায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, জল ব্যবস্থাপনা কিংবা সমাজ কাঠামো—প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধোলাভিরার চর্চা আজকের বিশ্বের জন্য এক মহামূল্যবান শিক্ষা।

ধোলাভিরার ধুলোয় চাপা ইতিহাস যেন বলে ওঠে, “আমি হারাইনি, আমি অপেক্ষায় ছিলাম—আবার আলোয় ফেরার।”