পৃথিবী যখন মহাকাশ থেকে দেখা হয়, তখন এর নীলাভ আভা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই নীল রঙের পেছনে লুকিয়ে আছে পানির এক অসীম রাজ্য। কিন্তু এই বিপুল জলরাশির মধ্যে মাত্র ২.৫ শতাংশ হলো মিঠা পানি, যার সিংহভাগই বরফ আকারে মেরু অঞ্চলে বা ভূগর্ভে আটকা পড়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের ব্যবহারযোগ্য মিঠা পানির পরিমাণ পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ০.০১ শতাংশ। এই সামান্য পরিমাণ পানি নিয়েই তো আমাদের বেঁচে থাকা, কৃষিকাজ, শিল্পোৎপাদন – সবকিছু। কিন্তু এই অমূল্য সম্পদের বণ্টন যে কতটা অসম, তা এই প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হবে।
বিশ্ব মিঠা পানির ভৌগোলিক বণ্টন
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৪২.৮ ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার মিঠা পানি রয়েছে। এই বিশাল সম্পদ কিন্তু সারা বিশ্বে সমানভাবে বণ্টিত নয়। কিছু দেশ প্রকৃতির কৃপায় পানিসমৃদ্ধ, আবার অনেক দেশ প্রতিদিন পানির অভাবে সংগ্রাম করে।
লাতিন আমেরিকা: প্রকৃতির পানির ভাণ্ডার
ব্রাজিল একাই বিশ্বের ১৩.২ শতাংশ মিঠা পানি ধারণ করে। আমাজন নদী প্রতিদিন যে পরিমাণ পনি প্রবাহিত করে, তা সমগ্র ইউরোপের সকল নদীর সম্মিলিত প্রবাহের চেয়েও বেশি। কলম্বিয়া (৫ শতাংশ) এবং পেরু (৩.৮ শতাংশ) তাদের উচ্চ বৃষ্টিপাতের কারণে এই অঞ্চলকে বিশ্বের সবচেয়ে পানিসমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করেছে।
উত্তর আমেরিকা: হ্রদ ও হিমবাহের দেশ
কানাডা (৬.৭ শতাংশ) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৬.৬ শতাংশ) মিলে উত্তর আমেরিকাকে পানিসমৃদ্ধ করে রেখেছে। গ্রেট লেকস অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠস্থ মিঠা পানির উৎস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলের পানির ভারসাম্য হুমকির মুখে।
এশিয়া: জনসংখ্যা ও পানির চাপ
চীন (৬.৬ শতাংশ) এবং ভারত (৩.৪ শতাংশ) বিপুল পরিমাণ মিঠা পানির মালিক হলেও বিশাল জনসংখ্যার কারণে এখানে পানির চাপ সবচেয়ে বেশি। গঙ্গা, ইয়াংজি এবং হুয়াংহো নদীগুলো ক্রমশ দূষিত হয়ে পড়ছে।
আফ্রিকা: সম্পদ ও সংকটের দ্বন্দ্ব
কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (২.১ শতাংশ) এবং পাপুয়া নিউগিনি (১.৯ শতাংশ) পানিসমৃদ্ধ হলেও অবকাঠামোর অভাব এখানে পানির সংকট তৈরি করেছে। সাহারা মরুভূমির দেশগুলোতে পানির জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয়।
মিঠা পানির সংকট: কারণ ও প্রভাব
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
গত ১০০ বছরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১°C বেড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পানিচক্রে। হিমালয়ের হিমবাহগুলো দ্রুত গলছে, যা ভবিষ্যতে নদীর প্রবাহে বড় ধরণের পরিবর্তন আনবে।
২. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণ
১৯৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ২.৫ বিলিয়ন, যা ২০২৩ সালে ৮ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। এই বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে পানির ব্যবহার বেড়েছে ৬ গুণ।
৩. কৃষি ও শিল্পের অত্যধিক ব্যবহার
বিশ্বের ৭০ শতাংশ মিঠা পানি ব্যবহার হয় কৃষিকাজে। ভারত ও চীনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপদজনকভাবে নিচে নেমে গেছে।
৪. দূষণ: অদৃশ্য শত্রু
প্রতিবছর ৩০০-৪০০ মিলিয়ন টন ভারী ধাতব বর্জ্য পানির উৎসে মেশে। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
সমাধানের পথ: টেকসই পানিব্যবস্থাপনা
১. পানিসংরক্ষণ প্রযুক্তি
ইসরায়েল বিশ্বের ৮৫ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার করে, যা একটি আদর্শ উদাহরণ। ড্রিপ সেচ পদ্ধতি পানির ব্যবহার ৬০ শতাংশ কমাতে পারে।
২. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
নীল নীলন ও মেকং নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
৩. গণসচেতনতা
ক্যালিফোর্নিয়ায় খরা মোকাবিলায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ পানির ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমিয়েছে।
পানি শুধু একটি সম্পদ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। এই প্রতিবেদন থেকে এটাই স্পষ্ট যে, পানির অসম বণ্টন, দূষণ ও অত্যধিক ব্যবহার আমাদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-6) অর্জনে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, প্রতিটি ফোঁটা পানির মূল্য যে কতটা, তা তখনই বোঝা যায় যখন কূপ শুকিয়ে যায়।