ঢাকাসোমবার , ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

আজকের সর্বশেষ সবখবর

মাইক্রো-আরএনএ এবং জিন নিয়ন্ত্রণ: আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত

রঞ্জন কুমার দে
ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪ ৫:৫২ অপরাহ্ণ । ৪০ জন

মাইক্রো-আরএনএ (microRNA) এবং জিন নিয়ন্ত্রণের গবেষণা বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ২০২৪ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারও এই বিষয়ে অসামান্য অবদান রাখার জন্য দেওয়া হয়েছে। জিন নিয়ন্ত্রণ এবং মাইক্রো-আরএনএর গবেষণার মাধ্যমে ক্যান্সার, নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ এবং জেনেটিক বিকলাঙ্গতার মতো জটিল সমস্যাগুলোর কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

২০২৪ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গবেষকদ্বয় হলেন ক্যাটলিন কারিকো এবং ড্রিউ ওয়েইসম্যান। তাঁরা মাইক্রো-আরএনএ এবং মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA)-এর কার্যকারিতা এবং জিন নিয়ন্ত্রণে এর ব্যবহার নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণা শুধু করোনাভাইরাসের mRNA-ভিত্তিক টিকা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি, বরং এটি জিনোম সংশ্লিষ্ট অন্যান্য থেরাপির ক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শক হয়েছে। ক্যাটলিন কারিকো পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন, যেখানে তিনি mRNA প্রযুক্তির মূল বিষয়গুলো উদ্ভাবন করেন। অন্যদিকে ড্রিউ ওয়েইসম্যান একই প্রতিষ্ঠানে ইমিউনোলজির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন।

মাইক্রো-আরএনএ হচ্ছে ছোট, একক-স্ট্র্যান্ড আরএনএ অণু যা একটি কোষের অভ্যন্তরে জিন প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো সাধারণত ২০-২২ নিউক্লিওটাইড দৈর্ঘ্যের হয় এবং জিনোমের অ-প্রোটিন-কোডিং অংশ থেকে উৎপন্ন হয়। মাইক্রো-আরএনএ প্রতিস্থাপিত মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA)-এর কার্যকারিতা বাধা দেয় অথবা ধ্বংস করে, যার ফলে নির্দিষ্ট প্রোটিনের উৎপাদন হ্রাস পায়। এই প্রক্রিয়াকে পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন সাইলেন্সিং বলা হয়।

জিন নিয়ন্ত্রণের মূল লক্ষ্য হলো সঠিক সময়ে এবং সঠিক মাত্রায় প্রোটিন উৎপাদন নিশ্চিত করা। জিন নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে কাজ করে, যেমন ট্রান্সক্রিপশনাল নিয়ন্ত্রণ, পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রোটিনের স্থায়িত্ব নিয়ন্ত্রণ। মাইক্রো-আরএনএ এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বিশেষত পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল পর্যায়ে কাজ করে, যেখানে এটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের সংশ্লেষ বন্ধ করতে পারে।

ক্যান্সার, নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ, এবং জেনেটিক রোগগুলোতে মাইক্রো-আরএনএ-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে কিছু মাইক্রো-আরএনএ টিউমার সাপ্রেসর বা অঙ্কুর প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে, কিছু মাইক্রো-আরএনএ ক্যান্সারের বৃদ্ধি এবং ছড়িয়ে পড়ায় সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে যে miR-21 নামের মাইক্রো-আরএনএ অনেক ধরনের ক্যান্সারের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এই কারণেই মাইক্রো-আরএনএ-নির্ভর থেরাপি বর্তমানে ক্যান্সার চিকিৎসার নতুন দিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের ক্ষেত্রে, যেমন আলঝেইমার বা পারকিনসন্স ডিজিজ, মাইক্রো-আরএনএ নিউরনের প্রোটিন উৎপাদন এবং সংকেত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট মাইক্রো-আরএনএ-এর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি এই রোগগুলোর অগ্রগতি থামাতে বা কমিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।

মাইক্রো-আরএনএ-নির্ভর থেরাপি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা পালন করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম মাইক্রো-আরএনএ তৈরি করছেন, যা রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ন্যানো-টেকনোলজির মাধ্যমে মাইক্রো-আরএনএ-সমৃদ্ধ ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে। এটি ক্যান্সার কোষে সুনির্দিষ্টভাবে থেরাপি পৌঁছে দিতে সক্ষম।

এছাড়া, মাইক্রো-আরএনএ-এর প্রোফাইলিং রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, রক্ত বা মূত্রে নির্দিষ্ট মাইক্রো-আরএনএর উপস্থিতি থেকে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাইক্রো-আরএনএ এবং জিন নিয়ন্ত্রণ গবেষণার মধ্য দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ২০২৪ সালের নোবেল বিজয়ী গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে মাইক্রো-আরএনএর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে জেনেটিক রোগগুলো সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অধ্যাপক ডেভিড বাল্টিমোর, যিনি জিনোম এবং মাইক্রো-আরএনএ বিষয়ে অগ্রগণ্য গবেষণা করেছেন, বলেন, “মাইক্রো-আরএনএ এমন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা শুধু রোগ নির্ণয় নয়, রোগ নিরাময়েও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।”

অন্যদিকে, অধ্যাপক মারিয়া কার্টিস উল্লেখ করেন যে মাইক্রো-আরএনএর গবেষণার মাধ্যমে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা (personalized medicine) আরও কার্যকর হবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট মাইক্রো-আরএনএ-নির্ভর থেরাপি তৈরি করা সম্ভব হবে, যা রোগীর জেনেটিক প্রোফাইলের ওপর ভিত্তি করে কাজ করবে।

যদিও মাইক্রো-আরএনএ এবং জিন নিয়ন্ত্রণ গবেষণার সম্ভাবনা অসীম, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। মাইক্রো-আরএনএ-এর কার্যকারিতা সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ জটিল। এছাড়া, মাইক্রো-আরএনএ-নির্ভর থেরাপি মানবদেহে প্রয়োগের আগে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মাইক্রো-আরএনএ এবং জিন নিয়ন্ত্রণ গবেষণা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই গবেষণার ফলে জটিল রোগের নিরাময় এবং রোগ প্রতিরোধের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে মাইক্রো-আরএনএ-নির্ভর থেরাপি রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।