ঢাকাসোমবার , ৭ এপ্রিল ২০২৫

যে আগুন নিভছে না: কারা পুড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীকে?

রঞ্জন কুমার দে
এপ্রিল ৭, ২০২৫ ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ । ১৮ জন

এক সকালে, ক্লাসরুমে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল রাহাত। শহরের ধোঁয়ায় ধূসর হয়ে যাওয়া আকাশ দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগে—“ম্যাডাম, পৃথিবী এত গরম হয়ে যাচ্ছে কেন?” প্রশ্নটা শুনে শিক্ষক এক মুহূর্ত থেমে যান। একটি শিশুর সরল জিজ্ঞাসা হয়তো নরম সুরে উচ্চারিত হয়, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর গভীরতম উদ্বেগ।

সম্প্রতি “Visual Capitalist” একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে, মাত্র ৩৬টি কোম্পানি পৃথিবীর মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী। ভাবা যায়! হাজার হাজার কোম্পানি, কারখানা, রাষ্ট্র ও নাগরিক মিলে যতটুকু দূষণ করছে, তার সমান পরিমাণ দূষণ করছে কেবল এই ৩৬টি কোম্পানি।

এই তথ্য উঠে এসেছে ২০২৩ সালের নির্ভরযোগ্য হিসাব-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান যে কোম্পানিটির, সেটি হলো সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি “Saudi Aramco”। পৃথিবীর সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানিগুলোর একটি এই সংস্থা একা হাতে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৪.৪ শতাংশের জন্য দায়ী। পরিসংখ্যান বলছে, যদি এই কোম্পানিটিকে একটি দেশ ধরে নেওয়া হয়, তাহলে এটি চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পরেই চতুর্থ বৃহত্তম কার্বন দূষণকারী হিসেবে স্থান পেতো। এ যেন গোটা বিশ্বকে একটানা তেল জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে উষ্ণ করে ফেলার আয়োজন।

তালিকার পরবর্তী নামগুলোও কম ভয়াবহ নয়। চীনের অন্যতম কয়লা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান CHN Energy এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান Coal India দুটোই প্রায় সমানভাবে ৩.৭ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। কয়লা পোড়ানো এবং তেল উত্তোলনের এই প্রতিযোগিতায় যারা সবচেয়ে এগিয়ে, তারাই আজ পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে। চীনের অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে CNPC, ChinaCoal, Cement Industry of China, এবং Jinneng Holding—যারা প্রত্যেকেই এক থেকে তিন শতাংশ হারে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণে ভূমিকা রাখছে।

ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইরাকের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জাতীয় তেল কোম্পানিগুলোও এই তালিকায় বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। ইরানের NIOC একা ২.৮ শতাংশ নিঃসরণ করে। ADNOC, QatarEnergy, ও Iraq National Oil Company সহ এসব কোম্পানি শত শত কোটি ব্যারেল তেল উত্তোলন ও ব্যবহার করে, যার ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ একদিকে যেমন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, তেমনি পৃথিবীর পরিবেশও হয়ে উঠছে বিপন্ন।

রাশিয়ার Gazprom এবং Rosneft—এই দুটি কোম্পানিও যথাক্রমে ২.৩ ও ১.৯ শতাংশ নিঃসরণের মাধ্যমে তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এদের জ্বালানি রপ্তানির পরিমাণ বিশাল, আর সেই বিপুল চাহিদাই তাদের অপরিকল্পিত খনন এবং জ্বালানির নির্ভরতা বাড়িয়ে তুলেছে।

উত্তর আমেরিকার দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই বহুজাতিক কর্পোরেশন যেমন ExxonMobil, Chevron, ও Peabody Energy দীর্ঘদিন ধরে বিশাল পরিমাণে তেল ও কয়লা উত্তোলন করে আসছে। তাদের মধ্যে ExxonMobil একাই ১.৩ শতাংশ নিঃসরণের জন্য দায়ী।

এতসব তথ্যের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, এই সব প্রতিষ্ঠান মূলত লাভের খাতিরে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতির দায়ভার তারা নিচ্ছে না। অথচ ক্ষতির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে প্রথম কাতারেই রয়েছে বাংলাদেশ, যার অবদান এই দূষণে প্রায় শূন্য।

বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতি বছরই বন্যা, খরা, নদীভাঙন কিংবা অতিবৃষ্টির মতো ঘটনা বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত ঘরবাড়ি হারাচ্ছে, লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে, কৃষিজমি অনাবাদী হয়ে পড়ছে। অথচ আমরা এই দূষণের জন্য দায়ী না হয়েও সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।

বিশ্বব্যাপী এই ৩৬টি কোম্পানির প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনগুলোতেও তাদের সরাসরি নাম নেওয়া হয় না। কারণ, তারা শুধু তেল ও গ্যাসের জোগানদার নয়, তারা অনেক দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক। উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো তাদের বিনিয়োগের আশায় চুপ থাকে, আর উন্নত দেশগুলো অনেক সময় তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বহু বছর ধরেই এই কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়ে আসছে। কিন্তু সেগুলোকে কার্যকর নীতিতে রূপ দিতে এখনও অনেক পথ বাকি। কিছু দেশ কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন করেছে, কেউ কেউ নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে, কিন্তু বড় পরিবর্তনের জন্য এখনও প্রয়োজন বিশ্বজুড়ে নীতিনির্ধারকদের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত।

তবে আশার আলোও একেবারে নেই বলা যাবে না। তরুণ প্রজন্ম এখন পরিবেশ নিয়ে আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। তারা প্রশ্ন করছে, প্রতিবাদ করছে, বিকল্প জ্বালানির কথা বলছে। “গ্রিন টেকনোলজি”, “সোলার এনার্জি”, “ইলেকট্রিক গাড়ি”—এসব ধারণা এখন আর শুধুই গবেষণাগারে আটকে নেই, বরং জীবনের বাস্তবতায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

রাহাতের মতো ছোট্ট ছেলেটি যখন এমন প্রশ্ন করে, তখন বুঝে নেওয়া যায় যে পরিবর্তনের সূচনা হয় প্রশ্ন থেকে, সচেতনতা থেকে। এখন প্রয়োজন সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা এবং দায়িত্বশীল হওয়ার।

কারণ, পৃথিবীর এই অবস্থা কেউ এক দিনে তৈরি করেনি, কিন্তু প্রতিদিন এই ক্ষতির পেছনে কাজ করে যাচ্ছে কিছু প্রতিষ্ঠান, যাদের আমরা আজও প্রশ্ন করতে ভয় পাই।

ভবিষ্যতের পৃথিবী যদি বাসযোগ্য রাখতে হয়, তাহলে এখনই সময়—এই ৩৬টি দূষণকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে বৈশ্বিকভাবে সোচ্চার হওয়ার। সময় চলে গেলে শুধু রাহাত নয়, পুরো মানবজাতির কাছেই আর কোনো উত্তর থাকবে না, থাকবে কেবল প্রশ্ন—”তোমরা তখন কিছু করো নি কেন?”