ঢাকাশনিবার , ৪ নভেম্বর ২০২৩

রাজশাহীর টি-বাঁধ ও মিনা বেগমের কালাই রুটি

ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল
নভেম্বর ৪, ২০২৩ ৩:১৪ অপরাহ্ণ । ১০৭৫ জন

১.
রাজশাহী গেলে পদ্মার পাড়ে টি-বাঁধে যাওয়াটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে। যেমন ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন শহরটা, তেমনি ছিমছাম টি-বাঁধ এলাকা। একেবারে সুনসান বাধানো ঘাট। সামনে বিস্তীর্ন পদ্মা। শাড়ির ভাঁজে মুঠো মুঠো ঢেউ। বর্ষায় ভরা যৌবনা। হেমন্তে কিছুটা শীর্ণকায়। তাতে কী? সুন্দরী সব সময়ই সুন্দরী। তার আবার কম বেশি হয় নাকি?

সকালে আসে প্রাতঃ ভ্রমণকারীরা। বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটা, শরীর চর্চা, গায়ে সুবাতাস মাখানো-সবই চলে। বিকেলে আসে দলে দলে আবালবৃদ্ধ বনিতা বিলাস ভ্রমণে। উন্মুক্ত নদীর অপরূপ শোভা দেখে সময় কাটাতে। এমন উদোম বাতাস আর কোথায়? ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। কেউ কেউ নৌকায় উঠে চক্কর দিয়ে আসে মাঝ নদীতে। পদ্মার জলকেলি কার না ভালো লাগে। বিকেলে ফুচকা বাদাম চটপটির অস্থায়ী দোকান বসে। তরুণ তরুণীদের রসনা বিলাসের উত্তম ব্যবস্থা। নিরাপত্তা রক্ষীদের টহলদারি শৃংখলা রক্ষা নিশ্চিত করে। রাজশাহী শহরবাসী গর্ব করে বলে, এটা মিনি কক্সবাজার। হবেই বা না কেন।

শুধু কি বেড়ানো। পদ্মা পাড়ের জীবন জীবিকায়নও জানা গেলো কিছুটা। গবেষণা সহকারী মামুনকে নিয়ে নেমে গেলাম নিচে, জলের কাছাকাছি। চপচপ বালুতীর ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দেখা নৌকার মাঝিদের সাথে। প্রতিদিন কত শত মজুরি শ্রমিক নৌকা করে পাড়ি জমাচ্ছে দূর গাঁও মাঝ চরে। কাজের খোঁজে। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে বলে পাইট। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় এখন পদ্মার চরে কলাই মশুরি বাদাম সব্জির আবাদ শুরু হয়েছে। পলি পড়া চরের আগাছা জংলা পরিষ্কার, জমি তৈরি, বীজ ছিটানো-হরেক রকমের কাজ। দুপুরের খাবার নিয়ে যাচ্ছে পুটলি বেঁধে। নৌকাযোগে আবার ফিরে আসবে বিকেল বেলা। জনপ্রতি ২০/৩০ টাকা ভাড়া। আসা যাওয়ায় ৫০/৬০ টাকা খরচ। বিকেলে আসে সৌখিন নৌকা ভ্রমণ বিলাসীরা। নৌকা ভাড়ার কামাই রোজগার মোটামুটি খারাপ না। খরচ পাতি বাদে গড়পড়তা দিনে হাজার বারো শত থাকে। কম কি?

২.
সাত সকালে অনেকেই নেমেছেন মাছ ধরতে পদ্মায়। বাঁশের চাই জড়ো করে রাখা আছে নদী তীরে। কিছু চাই পাতা আছে জলে। একজনকে দেখা গেলো চাই থেকে কিছু ছোট মাছ বের করে খালুইতে রাখতে। আরেকজনকে দেখলাম শক্ত হাতে খ্যাপলা জাল ঝাকি মেরে জলে ফেলতে। সামান্য কিছু গাং চেলা, ফ্যাসা মাছ উঠেছে। মহানন্দে সেগুলো জাল থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে দুজনে। সৌখিন মাছ ধরার একটা আধা-অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাও পাওয়া গেলো তাদের কাছ থেকে। প্রথমতঃ নদী তীরে প্রাতঃ ভ্রমণের অপার আনন্দ। এটা অর্থনীতির পরিভাষায় ইন্ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। দ্বিতীয়তঃ ঝাকি জাল জোরে ফিকে মেরে এবং পরে আবার জল থেকে টেনে তোলার শারীরিক ব্যায়াম। এটা কিছুটা ট্যাঞ্জিবল ও কিছুটা ইন্ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। তৃতীয়তঃ কুড়িয়ে টুকিয়ে যা কিছু মলা চেলা মাছ পাওয়া যায় ঐটাই লাভ। এর সবটাই ট্যাঞ্জিবল বেনিফিট। সব বেনিফিট কি টাকার হিসেবে হয়?

৩.
অনেকেই সাত সকালে ঘাটে এসেছেন থালা বাটি ধুতে। কেউ আবার কাপড় চোপড় ধুয়ে, গোসল সেরে, বালতি ভরে রান্নার জল নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। শহরের বাসায় এসব করতে যে পানির বিল গুণতে হয়, সেটা এখানে বেঁচে যাচ্ছে। ঐ যে অর্থনীতির প্রথম পাঠ, নদী তীরে জলের উপযোগিতা আছে, কিন্তু দুষ্প্রাপ্যতা নেই। কাজেই এখানে ওটার কোন দাম দিতে হয় না। এই সহজ হিসেবটা কে না বোঝে।

৪.
সবচেয়ে মজার দৃশ্য, এক সৌখিন মহিলা একটি টিয়া পাখিকে বেড়াতে নিয়ে এসেছেন খাঁচায় করে নদীর ঘাটে। পরম আনন্দে পাখির খাবারের বাসন কোসন ধুইয়ে মুছে নিলেন। খাঁচাটাকে ঘষে মেজে পরিস্কার করলেন। তারপর টিয়াকে পদ্মার ভাসান জলে ডুবিয়ে গোসল দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। মালিকের দারুণ সখ্যতা জমে গেছে টিয়া বন্ধুর সাথে। মানুষের কত কী বিচিত্র সখ!

৫.
প্রাতঃ ভ্রমণ শেষে মামুনকে নিয়ে চলে আসছিলাম টি-বাঁধ থেকে। রাস্তায় দেখলাম অনেক শ্রমিক লাইন ধরে যাচ্ছেন। গ্রাম থেকে এসেছেন। সবার গায়ে চলনসই জামাকাপড়। পায়ে সবার মোটামুটি স্যাণ্ডেল জুতা আছে। প্রত্যেকের বাহন সাইকেল। পেছনের সিটের সাথে সুকৌশলে বাঁধা বাশের ঝুড়ি ও ঊর্দ্ধমুখী কোদালের হ্যাণ্ডেল। বোঝা গেলো কোন নির্মাণ কাজে ছুটছেন ওরা। দিন মজুরি ছয় থেকে সাত শত টাকা। দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধিতে কিছুটা চাপে পড়েছে। তবে বাড়িতে সামান্য কিছু আবাদ আছে। কিছু হাঁস মুরগি ও দু একটি গরু ছাগল পালন করে মেয়ে ছেলে মিলে। তাতে খেয়ে পরে মোটামুটি চলে যায়। তবে এদের মাঝে শহুরে মধ্যবিত্তের হা-হুতাস নেই।

৬.
পথেই পড়লো সিমলা পার্ক। সার্কিট হাউজ রোডের ঠিক উল্টো দিকে। চোখে পড়লো এক মহিলার কালাই রুটির দোকান। মধ্য বয়সী মিনা বেগম। জীবন সংগ্রামের প্রত্যয় চোখে মুখে। রাস্তার ধারে খোলামেলা পরিবেশে ঝুপড়ি দোকান। বাসন কোসনে সাজানো রুটির সব আয়োজন। আটা ডলে মণ্ড করে রাখা আছে। কার না লোভ হয়। রাজশাহীতে এসে কালাই রুটি খাওয়া আমার আরেক নেশা। মহিলা সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। বসে পড়লাম কাঠের বেঞ্চে। লাকড়ির চুলোয় গরম গরম কালাই রুটি। সাথে সরষে তেলে পোড়া বেগুন ভর্তা। দারুণ মজা। তাও আবার সকাল বেলা পার্কের খোলা বাতাসে বসে পদ্মার পাড়ে।

৭.
রুটি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কালাই রুটির একটু ইতিহাস জানার আগ্রহ হলো। আরেকজন খদ্দেরও রুটি খাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, কালাই রুটি চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের জনপ্রিয় নাস্তা। মিনা বেগম যোগ করলেন, এটা এসেছে ইন্ডিয়া থেকে। ঠিকই তো। চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ ইন্ডিয়ার গা ঘেঁষা অঞ্চল। চাঁপাই ও রাজশাহীর আশপাশে পদ্মার যেসব চর রয়েছে, সেগুলোতে বর্ষায় প্রচুর পলি পড়ে। পানি নেমে গেলে ঐসব উর্বর মাটিতে প্রচুর মাসকালাই হয়। আর এটাই হচ্ছে কালাই রুটির প্রধান উপকরণ। সাথে অবশ্য কিছু চাল ও আটার গুড়িও দিতে হয়। কেউ কেউ ডালের আটাও মেশায়।

৮.
মিনা বেগমের কালাই রুটির দাম সাধারণত ২৫/৩০ টাকা পিচ। তবে কম বেশিও নেয়। কোন জোরাজুরি নেই। দেখলাম একজন পাগল কিসিমের লোক এলো। তাকেও মিনা বেগম একটি রুটি দিলো খেতে বিনা পয়সায়। গরীব গরীবকে চেনে। সাধারণ শ্রমিক রিক্সাওয়ালা সবাই আসে এখানে। সস্তায় রুটি-ভর্তা খায়। একজন শ্রমিক জানালেন, কালাই রুটি বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। পেটে থাকে অনেক ক্ষণ। দুই তিন দিন রাখা যায়, নষ্ট হয় না। তাইতো যারা ওপারে কাজে যায় সারাদিনের জন্যে, অনেকেই কালাই রুটি নিয়ে যায়।

৯.
কালাই রুটি এতটাই জনপ্রিয় যে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারও নাকি রাজশাহীর কালাই রুটি পছন্দ করেছেন। মিনা বেগম জানালেন, তার রুটি খেতে এখানে ঢাকার বড় বড় নেতারাও আসেন। কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কেন্দ্রীয় নেতার নামও বলে দিলেন গড় গড় করে। স্থানীয় বড় বড় সাহেবরাও নাকি লোক পাঠিয়ে তার দোকান থেকে কালাই রুটি নিয়ে যান। বোঝা গেলো, ব্যবসার জন্যে মিনা প্রচার ও মার্কেটিং কৌশলটাও বেশ রপ্ত করে ফেলেছে।

মিনার স্বামী মারা গেছেন কিছু দিন হলো। চার ছেলে বিয়ে থা করে আলাদা থাকে। একটি মাত্র মেয়ে। টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না। কন্যা দায়গ্রস্থ একজন মায়ের স্বাভাবিক আকুতি। সাধ্যমত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিদায় হলাম। রাজশাহী উপশহরে কত কালাই রুটির দোকান আছে। দু-একটাতে আগে খেয়েছিও। রুটির সাথে হাঁসের মাংস, ভর্তা ভাজি, কত কি। মিনা বেগমের কালাই রুটির সাথে হাঁসের মাংস ছিলো না। ছিলো না কোন বাহারি নাম বা বিজ্ঞাপন। কিন্তু ছিলো অফুরন্ত তৃপ্তির সাধ ও পথের পাশে প্রান্তজনের অকৃত্রিম আতিথেয়তা।

রাজশাহী, ৩১ অক্টোবর ২০২৩

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, প্রফেসরিয়াল ফেলো, বিআইডিএস এবং এমিরিটাস অধ্যাপক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

বি. দ্র. লেখাটি লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক ওয়াল থেকে পাবলিক হেলথ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।