যে কোন বয়সের মানুষের জ্বর হতে পারে। তবে শিশুদের জন্য এটা একটি বিশেষ সমস্যা। কোন শিশুর জ্বর হলে অভিভাবকরা অস্থির হয়ে পড়েন কি করতে হবে বুঝতে পারেন না, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং জ্বর না কমা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ডাক্তারও স্বস্তি পান না। জ্বর কমানোর জন্য সব অভিভাবকই কমবেশি কিছু কিছু চেষ্টা করে থাকেন যার কোনটা বিজ্ঞানসম্মত, আবার কোনটা নয়। তাই আজকের মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে অবশ্যই আমাদের ধারণা থাকতে হবে জ্বর কি এবং কেন হয়।
আমরা যখন কোন রোগ জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হই তখন আমাদের শরীরে অবস্থিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা এই জীবাণু ধ্বংস করতে এগিয়ে আসে, ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়। আর তাতে শরীরে বিশেষ করে আক্রান্ত স্থানে অনেক রাসায়নিক পদার্থ (Chemical Mediator) নিঃসারিত হয়। এসব রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং এই তাপমাত্রা যখন একটা নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে (৯৯.৫ ফা:) তখন শিশুর শরীরে জ্বর অনুভূত হয়। সুতরাং সারকথা হল ‘জ্বর’ শরীরে কোন সংক্রমণের প্রথম এবং প্রধান উপসর্গ। শরীরের তাপমাত্রা অনুযায়ী জ্বর বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে; মৃদু জ্বর: ৯৯ – ১০১ ডিগ্রি ফাঃ, মাঝারি জ্বর: ১০১ – ১০৩ ডিগ্রি ফাঃ, বেশি জ্বর: ১০৩ – ১০৫ ডিগ্রি ফাঃ, ভয়ঙ্কর জ্বর: ১০৫ ডিগ্রি ফাঃ এর বেশি।
জ্বর হলে কি হয়?
মৃদু জ্বর হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু হয় না, শিশু খেলাধুলা করে। তবে কখনও অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি আক্রান্ত শিশু নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কখনও খিটখিটে মেজাজের বা অস্থির হয়ে যায়। কিছুই খেতে চায় না, বমি হয়। অনেক সময় পেশাব কম করে। কখনও কখনও জ্বরের সঙ্গে খিচুনি হয় এবং সার্বিকভাবে শিশু তার প্রাণ চাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলে।
ঠিক যে সংক্রমণের জন্য জ্বর হয়েছে তার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসার পাশাপাশি জ্বর কমানোর জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিপ্রসূত সুনির্দিষ্ট সহায়ক চিকিৎসা দিতে হবে। তবে সবার আগে সম্মানিত অভিভাবকদের বলবো ধৈর্য রাখার জন্য এবং শিশুর প্রাণ চাঞ্চল্য যাতে বজায় থাকে তার দিকে খেয়াল রাখতে।
Supportive treatment
১. কাপড়/পোশাক কমিয়ে দেয়া: শিশুর শরীরের অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় কমিয়ে দেয়া, তাকে পাতলা জালির মতো কাপড় পরিয়ে রাখা বা গা খালি করে দেয়া। আমরা অনেক সময় জ্বর হলে বেশি বেশি কাপড়-চোপড় দিয়ে ঢেকে দেই, যা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
২. খোলামেলা বাসস্থান নিশ্চিত করা: ঘরের দরজা-জানালা খুলে দিয়ে সেখানে বাতাস চলাচল নিশ্চিত করা। ঘরে পাখা থাকলে তা চালানো। অনেক সময় আমরা এগুলো করি না, শিশুর ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে। এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
৩. শরীর মুছে দেয়া: যদি জ্বর ১০৩ ডিগ্রি বা তার বেশি হয় তবে হালকা গরম পানিতে গামছা/তোয়ালে ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মাথা, গলা, বোগলসহ সমস্ত শরীর মুছে দিতে হবে। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করি না বরং ঠাণ্ডা পানি কোন পাত্রে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় ঢালতে থাকি। এমনকি মাথা ও সমস্ত শরীর বরফ মেশানো পানি দিয়ে মুছে দেই, মাথায় আইস ব্যাগ, কপালে জলপট্টি দেই। এসব করার ফলে শরীরের বাহিরটা ঠাণ্ডা হলেও ভেতরের তাপমাত্রা কমে না বরং অনেকক্ষেত্রে শিশুর ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। এতে শিশু আরও অস্বস্তি বোধ করে।
৪. গোসল করানো: জ্বর হলে হালকা গরম পানিতে গোসলে কোন অসুবিধা নেই। আমরা জ্বর হলে গোসল একেবারে বন্ধ করে দেই। গোসলে শিশুর শরীর অনেক সতেজ থাকবে। তবে শিশু অস্বস্তিবোধ করলে গোসলের দরকার নেই।
৫. পানি/পানীয় বেশি খেতে উদ্বুদ্ধ করা: জ্বরের সময় সব ধরনের খাবার গ্রহণে শিশুর অনীহা থাকে। তার উপর তাপ বৃদ্ধির ফলে শরীরের অনেক জলীয় অংশ শুকিয়ে যায়। তাতে শরীরে পানির ঘাটতি হতে পারে। এবং কখনও কখনও শিশুদের পেশাব কমে যায়। সুতরাং জ্বরে আক্রান্ত কোন শিশু ভাত বা অন্য কোন শক্ত খাবারে আগ্রহী না হলে পানীয় যেমন শরবত, ফলের রস, কোমল পানীয়, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি অল্প অল্প করে বারে বারে দিতে হবে।
৬. খাবার দেয়া: জ্বর অবস্থায় কখনও কখনও শিশুর খাবার- দাবার দেয়া বন্ধ করা হয়। আবার অনেক সময় জ্বরে আক্রান্ত শিশুকে জোর করে খাওয়ানোরও চেষ্টা করা হয়। কোনটাই ঠিক নয়। সব খাবার যা সে খেতে চায়, অল্প অল্প করে দেয়া উচিত। শিশুকেই তার খাবারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে। আর একটা বিষয় মনে রাখা দরকার জ্বরের সময় মিষ্টি জাতীয় জিনিস কম দেয়া ভাল। কারণ তা আক্রমণকারী রোগ জীবাণুর জন্য উপাদেয়। এ সময় ভিটামিন সি, বি কমপ্লেক্স এবং তৈলাক্ত ভাজি ভাজি ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবার দেয়া ভাল।
৭. ওষুধপত্র: তাপমাত্রা ১০২-১০৩ ডিগ্রি ফাঃ বেশি না হলে Paracetamol দেয়ার দরকার নেই। ওষুধ খেয়ে শিশু বমি করলে ওষুধটি পায়ু পথেও দেয়া যায়। এখানে বলা উচিৎ জ্বর দ্রুত কমানোর জন্য Diclofenac বা অন্য কোন NSAID ওষুধ কোনভাবেই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা উচিত হবে না।
৮. কোন শিশুর যদি পূর্বে জ্বর হলে খিচুনির প্রবণতা থাকে তবে জ্বর কমানোর পাশাপাশি Diazepam নির্দিষ্ট মাত্রায় খাইয়ে দিতে হবে।
পরিশেষে একথাই বলবো, আপনার শিশুর জ্বর হলে: ধৈর্য রাখুন আলোচনা মোতাবেক পরিচর্যা করুন, আপনার স্নেহের স্পর্শে তাকে আশ্বস্ত করুন- তার প্রাণ চাঞ্চল্যের দিকে লক্ষ্য রাখুন আর এগুলোই জ্বর হলে প্রধান বিবেচ্য বিষয়, শুধু থার্মোমিটারের READING নয়।
নোট: শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লার লিখিত ‘শিশু স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাঁর অনুমতিক্রমে।