ঢাকামঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর ২০২৪

শিশুর ডেঙ্গু জ্বর

প্রফেসর ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লা
নভেম্বর ১২, ২০২৪ ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ । ১৬০ জন

সমগ্র দেশেই এখন ডেঙ্গু জ্বর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এডিস নামক এক প্রকার মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে কতটা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে তার বেশ কিছু খবর আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে। তবে রোগের সংক্রমণ এবং তা থেকে রোগের প্রকোপ কতটুকু হবে তা নির্ভর করছে প্রথমত বয়স এবং দ্বিতীয়ত আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের সার্বিক অবস্থার ওপর।

শিশুদের শরীরে যখন ডেঙ্গু রোগ বিস্তার লাভ করে তখন রোগের উপসর্গসমূহ ‘ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের মতো নাও হতে পারে। ক্লাসিক্যাল বা আদর্শ ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে যেমন চোখের পিছনে, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা বা হাত-পা কামড়ানোর সঙ্গে তীব্র বা স্বল্প মাত্রার জ্বর দুই থেকে সাত দিনের জন্য দেখা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তীব্র জ্বর সর্দি বা নাক দিয়ে পানি পড়া এভাবেও ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। তবে জ্বর যদি সাত দিনের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে টাইফয়েড সহ অন্যান্য রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়।

সুতরাং অভিভাবকদের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে শিশুর জ্বর ও ঠাণ্ডা লাগা রোগটিকে উপেক্ষা না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত একজন শিশু হয়ত তার গা ব্যথার কথা মা- বাবাকে পরিষ্কার করে বলতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে একটি শিশুর মাঝে তীব্র জ্বর, অস্থির ভাবসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে লাল দানাদার ফুসকুড়িসহ কালচে ছোপ ছোপ দাগ, দাঁতের গোড়া ও মুখ দিয়ে রক্ত পড়া, চোখে রক্ত জমে যাওয়া, আলকাতরার মতো কালো পায়খানা, হঠাৎ শরীর ঘেমে যাওয়া এবং ঠাণ্ডা হয়ে পড়া এসব উপসর্গ একজন চিকিৎসক যদি দেখতে পান তবে তিনি শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

ডেঙ্গু জ্বর কেন রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে?

ডেঙ্গু জ্বর অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো জ্বর আর গা ব্যথার উপসর্গ নিয়ে দেখা দিলেও পরবর্তীতে তা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে। খুব অল্প সময়ে শুধু শিশু নয়, যে কোন ব্যক্তির জীবন সঙ্কটজনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে বিস্তার লাভ করার পর ক্ষুদ্র রক্তনালির গাত্রসমুহকে আঘাত করে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালিগুলো পরবর্তীতে আর রক্তের জলীয় অংশ ধরে রাখতে পারে না। ফলে শরীরের মাঝে তখন এক ধরনের পানি শূন্যতা বিরাজ করে। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকাগুলোকেও আক্রমণ করে বসে। রক্তের অণুচক্রিকাগুলো ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে থাকায় রক্ত জমাট বাধা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো থেকে সহজেই রক্তক্ষরণ হতে শুরু করে।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা

১. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের শিশু যার শরীরে ডেঙ্গু জ্বরের কোন ভয়াবহ উপসর্গ দেখা দেয়নি তাকে একজন চিকিৎসক জ্বর কমানোর জন্য ট্যাবলেট বা সিরাপ প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

২. শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি করে পানি বা পানি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

৩. শিশু-কিশোরদের বিশ্রামে রাখা কষ্টকর ব্যাপার। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের যথাসম্ভব বিশ্রামে রাখা, স্কুল থাকলে অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে স্কুল থেকে ছুটি নেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের জন্য আরও কিছু টিপস

১. ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তকে রোগীদের এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সেবনের প্রয়োজন নেই।

২. বাবা-মা অনেকক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ছাড়াও জ্বর ও গা ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই এসপিরিন, এনএসএআইডি (আইবুপ্রফেন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম) গোত্রের ওষুধ তাদের সন্তানদের সেবন করিয়ে থাকেন। যা কি না ডেঙ্গু জ্বরের উপশম না ঘটিয়ে উল্টো ক্ষতি করে থাকে।

৩. ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিশু বা বড়দের শরীরের মাংসপেশীতে কোন ধরনের ইঞ্জেকশন দেয়া যাবে না।

হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের চিকিৎসা

হাসপাতালে রোগী ভর্তি করার প্রথম উদ্দেশ্যই হলো রোগীর বিশ্রামকে নিশ্চিত করা।

১. শিশুর শরীরে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা প্রয়োজন অনুসারে খাবার স্যালাইন থেকে শুরু করে Normal saline (NS) স্যালাইন প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের জাতীয় নির্দেশিকাটি হুবহু অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

২. রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং ল্যাবরেটরি থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী রক্তের অণু চক্রিকা এবং প্রয়োজনে রক্ত দানের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালন লাগে না।

৩. ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে পুরো মাত্রার এনএস স্যালাইন না দিয়ে ১/২ বা এক-চতুর্থাংশ মাত্রার স্যালাইন প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা দিয়ে থাকেন।

৪. ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গবেষণা বা নিবন্ধের মতামত অনুযায়ী স্টেয়রেড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগের কোন বিধান নেই বললেই চলে। অনেকে হোমিও ওষুধে ডেঙ্গু জ্বর নিরাময়ের চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস নিধন তথা চিকিৎসার বিধান এপর্যন্ত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতি পায়নি।

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসকেরা যে ধরনের পর্যবেক্ষণ প্রতিনিয়ত করে থাকেন

১. নির্দিষ্ট সময়ান্তে ব্লাড প্রেসার পর্যবেক্ষণ করা

২. নাড়ীর মাত্রা নিরূপণ করা

৩. ইনটেক আউটপুট চার্ট পর্যবেক্ষণ করা

৪. পালস প্রেসার পর্যবেক্ষণ করা যেন তা ২০ মি. মি. মার্কারির নিচে না যায়

৫. ক্যাপিলারি ফিলিং প্রেসার পর্যবেক্ষণ করা

৬. যদি সম্ভব হয় প্রতিদিন অন্তত একবার রক্তের হেমাটোক্রিট ও অণুচক্রিকার পরিমাণ নিরূপণ করে তদানুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তন অথবা সংযোজন ঘটানো

ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে কি ধরনের ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করাবেন

১. জ্বরের ২৪-৪৮ ঘন্টার ভিতরে আক্রান্ত রুগীর রক্তের NS, Dengue antigen করতে হবে।

২. ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস নিরূপণে ইম্যুনোলজিক্যাল পরীক্ষা যেমন IgG এবং IgM পরীক্ষা করানো হয়। কিন্তু জ্বরাক্রান্ত হওয়ার সাতদিন আগে এই পরীক্ষার ইতিবাচক ফল কখনও পাওয়া সম্ভব হবে না।

৩. ডেঙ্গু জ্বর শরীরে সংক্রমণের মাধ্যমে কতটুকু ক্ষতি করছে তা নিরূপণের সহজ পরীক্ষা হলো রক্তের পিসিভি বা হেমাটোক্রিট নিরূপণ এবং প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা পরীক্ষা করা – এ দুটো পরীক্ষাই মূলত একজন চিকিৎসককে রোগী ব্যবস্থাপনার ব্যাপক দিক নির্দেশিকা দিয়ে থাকে।

নোট: শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ডা: মো: আবিদ হোসেন মোল্লার লিখিত ‘শিশু স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাঁর অনুমতিক্রমে।