ঢাকামঙ্গলবার , ১৪ নভেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

‘অ্যাকসেস টু ডায়াবেটিস কেয়ার’

ডায়াবেটিস কী? নিয়ন্ত্রণ কীভাবে?

পাবলিকহেলথ ডেস্ক
নভেম্বর ১৪, ২০২৩ ৩:৫৫ অপরাহ্ণ । ২৬৪ জন

ডায়াবেটিস এক নীরব ঘাতকের নাম। রোগটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। সারা পৃথিবীতে ২৮৫ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং এর শতকরা ৭০ ভাগই দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। বাংলাদেশ এখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছে। রোগটি যে হারে বাড়ছে, তাতে বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যেই সপ্তম স্থানে উঠে আসবে।

ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।

ইনসুলিন মানুষের শরীরের কোষে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ একটা ‘চাবি’র মতো কাজ করে। এর সাহায্যে আমাদের খাবার থেকে যে চিনি বা শর্করা (গ্লুকোজ) পাওয়া যায়, তা রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কোষে প্রবেশ করে। এরপর কোষ শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে। ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্ন্যাশয়ের বিশেষ কোষ দিয়ে তৈরি হরমোন আই-লেটস থেকে। ডায়াবেটিস-জনিত ইনসুলিনের তারতম্যের জন্য আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রার তারতম্য ঘটে। শরীরে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।

ডায়াবেটিস হলো মানুষের অসংক্রামক দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর একটি। একবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে সারাজীবন এ রোগ পালতে হবে। কারণ ডায়াবেটিসের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা, টিকা বা ভ্যাকসিন নেই।

সুতরাং হওয়ার আগেই সাবধান। সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এ রোগ যাতে না হয় সে ব্যবস্থা করা। আর কেউ যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েই থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই জানতে হবে এর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করতে হবে, না করলে কী কী জটিলতা হবে।

ডায়াবেটিসের ধরন

  1. টাইপ-১

  2. টাইপ-২

টাইপ-১ এবং টাইপ-২ হলো ডায়াবেটিসের দুটি সাধারণ রূপ।

ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ রূপটিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন-অনির্ভর ডায়াবেটিস বলা হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসকে প্রাপ্তবয়স্ক সূচক (adult-onset) ডায়াবেটিস-ও বলা হয়, কারণ এটি সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পরে প্রকাশ পায়। তবে, ইদানিং কম-বয়সীদেরও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হচ্ছে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর নিজস্ব ইনসুলিন তৈরি করতে সক্ষম। কিন্তু প্রায়ই এটি পরিমাণে যথেষ্ট নয় বা কোষ যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া করে না। অর্থাৎ ইনসুলিন শরীরের কোষগুলোকে খোলার জন্য চাবি হিসাবে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে শর্করা কোষে প্রবেশ করতে পারে না। একে বলা হয় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্স। টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত স্থূলকায় ব্যক্তি এবং শারীরিক পরিশ্রম-বিহীন (sedentary) জীবনধারার অভ্যস্ত ব্যক্তিদের হয়ে থাকে।

এছাড়া অন্যান্য ধরনেরও ডায়াবেটিস হতে পারে— যেমন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, নিওনাটাল ডায়াবেটিস, জেসটেসানাল ডায়াবেটিস ইত্যাদি।

ডায়াবেটিসের লক্ষণ

টাইপ-১ ডায়াবেটিস-এর সূত্রপাত খুব দ্রুত ঘটে এবং নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে একদম হঠাৎ করে—

  • তীব্র পিপাসা পাওয়া
  • অতিরিক্ত প্রস্রাবের প্রবণতা
  • দ্রুত ওজন কমতে থাকা
  • প্রচণ্ড ক্ষুধা
  • দুর্বলতা/ক্লান্তি/অবসাদ
  • অস্বাভাবিক বিরক্তি
  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • বমি বমি ভাব
  • পেটে ব্যথা
  • অপ্রীতিকর গন্ধের অনুভূতি
  • চুলকানি

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সূত্রপাত সাধারণত ধীর গতিতে হয়। লক্ষণগুলোও টাইপ-১ ডায়াবেটিসের মতো স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না। এই কারণে অনেকে অসতর্ক থাকে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে—

  • ক্ষতস্থান শুকাতে সময় বেশি লাগা
  • তীব্র তৃষ্ণা
  • অতিরিক্ত প্রস্রাবের প্রবণতা
  • দ্রুত হারে ওজন কমা
  • অপ্রীতিকর গন্ধের অনুভূতি
  • হাতে এবং পায়ে ঝিনঝিন করা
  • চুলকানি
  • মূত্রনালীতে সংক্রমণ
  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন
  • মাথাব্যথা
  • মাথা ঘোরা
  • বগল এবং ঘাড়ের কাছে কালচে ছাপ

এছাড়া বারবার ছোটখাটো অসুখ হওয়া, যেমন—

  • ঘনঘন শরীরে ফোড়া হওয়া
  • প্রস্রাবে ইনফেকশন হওয়া
  • জিহ্বায় সাদা সাদা ক্যানডিডার আক্রমণ
  • নারীদের যৌনাঙ্গে ঘন ছত্রাক জাতীয় রোগের আক্রমণ ইত্যাদি
  • পায়ে ঘা হওয়া বা পায়ের আঙ্গুলের মাঝে ছত্রাকের আক্রমণ।

কেন বাড়ছে ডায়াবেটিস?

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। মানুষের ওজন বাড়ছে, কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম কমে যাচ্ছে, মানসিক চাপ বাড়ছে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হচ্ছে। এসব নানা কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বাড়ছে।

অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করাজাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্থূলতা বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ, টেলিভিশন আর কম্পিউটার গেম ও ফেসবুক, শহুরে অলস জীবন, গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা। শিশুদের বেলায় ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনার অত্যধিক প্রতিযোগিতা, মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ, খেলাধুলার প্রতি অনীহা বা পড়াশোনার ব্যস্ততায় সময়ের অভাব ইত্যাদি তাদের আরো বেশি অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তুলছে আর বাড়াচ্ছে রোগব্যাধি।

গ্রামের শিশুদের ছেলেবেলার অপুষ্টি এবং বড় হয়ে শহরে অভিবাসনের পর অধিক পুষ্টির মন্দচক্রও এখান ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। একসময় শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্থ মানুষ যখন গঠাৎ করে অলস বা পরিশ্রমহীন জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে, তখন তাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

এছাড়া ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

ডায়াবেটিসের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

ডায়াবেটিস-জনিত অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বকে প্রতিরোধ করতে হলে গোড়াতেই ঠেকানো ছাড়া বিকল্প নেই। শুধু জীবনযাত্রার একটুখানি পরিবর্তন, সচেতনতা ও সদিচ্ছা শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করতে পারে।

শিক্ষা ও সচেতনতা : যাদের ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা আছে তারা ৩০ বছর বয়স থেকেই নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা। আর যাদের বয়স ৪০ পেরিয়েছে, তাদের অবশ্যই নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রাথমিক অবস্থায় রোগের জটিলতা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে এবং এগুলো শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আরও বাড়তি সমস্যা থেকে বাঁচা সম্ভব।

খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যাভ্যাসের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো এবং পরিমাণমতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ছোটবেলা থেকেই বেশি বেশি সবুজ শাকসবজির সাথে প্রয়োজন অনুযায়ী মাছ খেতে হবে। কম চর্বি ও কম শর্করাযুক্ত খাদ্য খেতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত কোমলপানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি পরিহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন মিষ্টি, শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি কম খেতে হবে। মন্দ খাদ্যাভ্যাসের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।

কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম : ডায়াবেটিসের রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। নিয়মিত কায়িক শ্রম এবং যত অল্পই হোক, সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা ইত্যাদি। সম্ভব হলে সাঁতার বা জগিং করা, ব্যায়ামাগারে গিয়ে সুশৃঙ্খল ব্যায়াম করা। শিশু-কিশোর ও বয়স্ক, সবার মধ্যেই কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন : ডায়াবেটিক রোগীর জীবনকাঠি হলো শৃঙ্খলা। এর মানে সবকিছু নিয়মমাফিক মেনে চলা, যেমন খাওয়া-দাওয়া, ঠিকমতো হাঁটাচলা বা ব্যায়াম, ওষুধপত্র নিয়মমাফিক ব্যবহার করা ইত্যাদি। যারা শৃঙ্খলা মেনে চলে তারা যেমন ডায়াবেটিস হওয়া থেকেও মুক্ত থাকতে পারবেন, এমনকি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে একে নিয়ন্ত্রণে রাখাও খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার হবে।

ডায়াবেটিসে কী কী খাওয়া যাবে না?

ডায়াবেটিসে কখনোই শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া চলবে না। বিশেষত—

  • যেসব খাদ্য বা পানীয়তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে, সেগুলো বর্জন করতে হবে।
  • কাঁচা লবণ খাওয়া এড়াতে হবে।
  • বেশি ভাজা ও তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
  • অতিরিক্ত চা বা কফি পান করা যাবে না।
  • ফ্যাট-যুক্ত দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার বর্জন করতে হবে।
  • ভাত, আলু, কলা এবং গাজরে শর্করা বেশি থাকে। সুতরাং এ খাবারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

সুগার এবং ডায়াবেটিস-এর মধ্যে পার্থক্য কী?

ব্লাড সুগার বা গ্লুকোজ হল আমাদের রক্তে অবস্থিত শর্করা বা চিনি। এই শর্করা আমাদের খাবার থেকে আসে এবং এটি শরীরের শক্তির প্রধান উৎস। শরীরে শক্তির চাহিদা পূরণের জন্য, রক্ত শরীরের প্রত্যেকটি কোষে গ্লুকোজ বহন করে। ডায়াবেটিস হল এমন একটি রোগ যেখানে রক্তে এই শর্করার ভারসাম্য বজায় থাকে না।