‘টাকার খেলা’ বাংলাদেশে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ৯০ পরবর্তীতে দলীয় নিবেদিত প্রাণ, সৎ ও অভিজ্ঞ কর্মীর চেয়ে টাকার শক্তিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলগুলো। দলীয় তহবিলে কে কত বেশি টাকা ডোনেট করছে তার ভিত্তিতে এমপির মননোয়ন ফর্ম দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বরের পদে নির্বাচনে কোটি টাকা খরচ করে।
পরবর্তীতে এমপি হলেই ৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল দিয়ে বৈধভাবে লুটপাটের আরও একটা দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বহু আমলা চাকরিকালীন উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্নভাবে জনগণের টাকা বাগিয়ে নিয়ে অবসরে জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসে কোটিপতিদের ক্লাব সদস্য তথা এমপি হয়েছেন। এভাবে অগাধ বিত্তবৈভব না থাকায় দিনকে দিন ত্যাগী ও ভালো মানুষের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। ফলে যার যত টাকা, সে তত রাজনীতিতে যোগ্য-এই পরিস্থিতিই রাজনীতি নষ্টের মূল কারণ।
ভোট কেনা বেচা এখনও ওপেন সিন্ডিকেট। অনেক ভোটারও মনে করেন ভোট যখন দিবো তখন প্রার্থী কিছু ট্যাকা দিবে না তা হয় কী করে। প্রার্থীও জেতার পর সংসদে গিয়ে বা চেয়ারম্যান-মেম্বর হওয়ার পর ভাবেন ভোট কিনেই তো ক্ষমতায় এসেছি তাই জনগণ কোন ব্যাটা … । বৈধ আয় দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এজন্যই বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমান বাড়ছে। কারণ এটা নিরাপদ বিনিয়োগ। ৫ কোটি টাকা দলীয় ফান্ডে দিয়ে নমিনেশন নিয়ে আরও ১০ কোটি টাকা খরচ করে সংসদে গেলেই তো ৫০/১০০/২০০ কোটি টাকা কামায়ের সুযোগ খুলে যাবে।
গত ১৫ বছরে কালো টাকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুষ্ঠুধারার রাজনীতিকে গলাটিপে প্রায় শ্বাসঃপ্রশ্বাস বন্ধ করে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নির্বাচনসহ দলীয় কর্মকান্ডে টাকার স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।(নির্বাচনী হলফ নামার মতো মিথ্যা পৃথিবীতে আর নেই)
কালো টাকার সাথে পেশিশক্তির যোগসূত্র আছে, তাও দেখা গেছে দেশের রাজনীতিতে। এই কালোটাকা ও পেশিশক্তিনির্ভর ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি কখনও নেতা বা লিডারশিপ তৈরি হতে দেয় না।
খেয়াল করে দেখেন, বিগত দিনে সম্ভাবনাময় তরুণ-উদীয়মান নেতাদের বিভিন্নভাবে সরিয়ে দেয়া হয়েছে রাজনীতি থেকে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির এমন ন্যারাটিভ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, টাকা ছাড়া-ক্ষমতা ছাড়া রাজনীতি হয় না। নেতা মানেই দলে বলে বেশ কিছু মানুষে আগে পিছে পিছে হাটবে-তান্ডব করে নেতাকে নিয়ে যাবেন-শত শত মোটর সাইকেলে হর্ণ বাজিয়ে বিকট শব্দে যাবেন নেতাকে এটাই দেখেছে বাংলাদেশ।
বলতে পারেন বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে টাকা খরচ করে। হ্যাঁ নিশ্চয় করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে একটা অটো জবাবদিহিতা আছে, আইনের শাসন আছে, নাগরিক অধিকার আছে। যেখানে টাকা লেনদেন করতে হয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। ফলে টাকা দাতা ও গৃহীতাকে হিসাব দিতে হয়। দলীয় ফান্ড সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা এবং খরচের বিষয়ে স্বচ্ছ থাকতে হয়। যুক্তরাজ্যে তো রীতিমত রাজনীতিবিদদের অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়ার সময় প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে খাবার কিনে ওখানে ডোনেট করার রেওয়াজ আছে।
যুক্তরাজ্যে কেউ বাড়ি-সম্পদ কিনলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কে সলিসিটারের মাধ্যমে কিনতে হয় এবং ক্রেতার অর্থের উৎস্যে ভুল/অনিয়ম থাকলে কিংবা বিক্রেতার কোনো অনিয়ম থাকলে দুই সলিসিটার ফেঁসে যাবে। তাদের জেল-জরিমানার পাশাপাশি সলিসিটারের মহামূল্যবান লাইসেন্স বাতিল হবে। ফলে নিজেদের স্বার্থেই ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পত্তির ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সবোর্চ্চ সর্তক থাকেন উভয় পক্ষের সলিসিটাররা।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কেউ নির্বাচনী তহবিলে টাকা দিলে সেটাও ঘোষণা দিতে হয়। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে মাইক্রোসফট, গুগল, আমাজনসহ বড় বড় কোম্পানিগুলো ১ মিলিয়ন ডলার তহবিলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো নগদ টাকার লেনদেন দুনিয়ার কোথাও করার সুযোগ নেই। এ জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সমপরিমান একটা শ্যাডো বা ছায়া অর্থনীতি আছে, যেটাকে ভদ্র বা কেতাবি ভাষায় বলে কালো টাকার অর্থনীতি। এই কালো টাকার অর্থনীতি বাংলাদেশের বুকে জেঁকে বসা হিমালয় পর্বত সমান হয়েছে। এটার সুবিধাভোগী শুধু রাজনীতিবিদরা নয়, কৃষক-কৃষণী, খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমজীবি, সাধারণ দোকানী ও দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসী ভাই-বোন ছাড়া অন্য সবাই। রাজনৈতিক-আমলা-আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ একটা সার্কেল। এই জগদ্দল পাথর সরানো খুব জরুরি। কিন্তু খুবই কঠিন কাজ বটে। এক প্রজন্মে হয়তো সম্ভব হবে না কিন্তু একদিন মানুষ দাঁড়াবেই কালো টাকার জগদ্দল পাথর সরিয়ে দিতে এবং দেবে।
তাই দেশে গণতান্ত্রিক ধারার সুষ্ঠু রাজনৈতিক দল পরিচালনার জন্য সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে দলের অর্থ সংস্থান বা তহবিল সংগ্রহ এবং তা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সাথে ব্যবস্থাপনা করা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নতুন দল গঠিত হয়েছে। তাদের জন্য শুভ কামনা এবং একইসঙ্গে পুরানো ক্ষমতাকেন্দ্রিক কালো টাকা ও পেশিশক্তি নির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের অর্থে স্বচ্ছতার সাথে রাজনীতি পরিচালনা করবে এই প্রত্যাশা। আয় ও ব্যয়ে সব সময় স্বচ্ছতার সাথে পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একইসাথে বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থগুলো সরিয়ে রাখার সবচেয়ে জরুরি। কারণ একা একা ভালো থাকা যায় না, বাংলাদেশটাকে একটা দেশে পরিণত করতে হবে। যেখানে সরকার আসবে যাবে কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে জনগণের সেবায়। হানাহানি-বিভেদে প্রতিহিংসা বাড়বে কিন্তু তাতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।
আমাদের তরুণরা পারে সব কিছু পাল্টে দিতে তা ২০২৪ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আরও একবার প্রমাণ হয়েছে। শেষ করি আফ্রিকার দেশ বতসোয়নার সাম্প্রতিক নির্বাচনের পালাবদলের একটি তথ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত একটাই দল ক্ষমতায় ছিল। ৫৮ বছর পর নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিরোধী দল। অবসান হয়েছে ৫৮ বছরের এক সরকারের ক্ষমতায় থাকা বতসোয়ানা ডেমোক্রেটিক পার্টি-বিডিপি’র । ভোট গণনার সময় ক্ষমতাসীন দলের সরকার প্রধান বিরোধী দলের নেতাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন ভোটের ফলাফল যাই হোক আমি মেনে নেবো। হার্ভাড গ্যাজুয়েট বিরোধী দলী নির্বাচনে জিতেছেন এবং দলের প্রধান অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা দেশটির সরকার প্রধান হয়েছেন। দেশের কোথাও কোনো টুঁ শব্দ হয়নি, রাজধানীসহ গ্যাবরোনেসহ কোথাও কেউ বুজতেই পারেনি ৫৮ বছর পর নতুন দল শাসন শুরু করেছে।
মজার ব্যাপার দ্যা আমব্রেলা ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ(ইউডিসি) কোয়ালিশন পার্টির নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেয়াসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেই বলছেন, ভোট গণনার দিন টেলিফোনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বতসোয়ানা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট তাকে ফোনে বলেছেন, ‘ফলাফল যাই হোক তিনি মেনে নেবেন…’ কী দারুণ পারস্পরিক সৌহাদ্য ও দেশের প্রতি ভালবাসা তাদের। আমরাও চাই লাল সবুজের এই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও দুনীতিমুক্ত ১৭ কোটি মানুষের দেশ। রাজনৈতিক ভেদাভেদ থাকবে কিন্তু হানাহানি থাকবে না, বিদ্বেষ-প্রতিহিংসা থাকবে না, দুর্নীতিমুক্তি থাকবে, আমলারা সরকারের পক্ষে নয়,জনগণের পক্ষে কাজ করবেন-সকল ধর্মের সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবেন। কেউ পিছিয়ে থাকবে না , কাউকে পিছিয়ে রাখবো না। পরিবেশ রক্ষাসহ দেশের উন্নয়নে এই হোক আমাদের নতুন দিনের আহ্বান।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, একাত্তর, টেলিভিশন sinhasmp@yahoo.com