ধূমপান সকল মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, ধূমপায়ীরা ভিক্টিম, তারা সিগারেট কোম্পানির নেশা চক্রান্তের শিকার। প্রকৃত অদৃশ্য অপরাধী অন্য কেউ। তাদের চেনা জরুরি। গবেষণার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে নারীদের মাঝে সিগারেট সেবনের প্রবণতা কম ছিল। এছাড়া যে সকল কিশোর বয়োজোষ্টদের সামনে সিগারেট খায়, তাদের অসামাজিক বা বখাটে হিসেবে চিহ্নিত করা হত। অথবা বয়োজোষ্টদের সম্মান বা সামাজিকতারর অংশ হিসেবে, এখানো অনেকেই সবার সামনে ধূমপান করে না।
সিগারেট কোম্পানিগুলো ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, খুবই গোপনীয়ভাবে বিগত কয়েক বছর ধরে কতগুলো নোংরা কাজ শুরু করেছে। আমাদের দেশে তরুণদের সংখ্যা বেশি এবং তাদের মাঝে বড় একটি অংশ নারী। তারা নাটক সিনেমায় সিগারেট খাওয়াকে অভিজাত্য ও আধুনিকতা হিসেবে প্রদর্শন শুরু করে। এ কাজে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে কিছু পরিচালক, প্রযোজন এবং কিছু অভিনয় শিল্পী। চরিত্রের প্র্রয়োজনে তারা পানি না খেলেও মদ, সিগারেট খাওয়াকে অপরিহার্য হিসেবে দেখানো হয়।
তাদের এই নোংরা কাজ শুধু নাটক সিনেমায় সীমাবদ্ধ না। এ কাজের অংশ হিসেবে সিগারেট কোম্পানি ঢাকা বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট ধূমপানের স্থান করে দিচ্ছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট এ ধূমপানের স্থান করতে তারা ব্যয় করছে লক্ষ টাকা। এ কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের সামাজিক যে রীতি আছে তা ভাঙ্গা। তাতে তাদের ব্যবসা বাড়বে। বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট-র গবেষণায় দেখা যায়, দেশের চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগস্থ ৮টি জেলা শহরে বিদেশী দুইটি তামাক কোম্পানির সরাসরি মদদ ও অর্থায়নে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ধূমপানের স্থান গড়ে উঠেছে। এছাড়া আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ স্থানেই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদেরকে অবাধে ফেরী করে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে দেখা গেছে। এমনকি ক্রেতা-বিক্রেতাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে নানা ধরণের উপহার সামগ্রী প্রদানেরও প্রমাণ মিলেছে।
করোনার পর হতে ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোর ভিতরে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির মদদে গড়ে উঠছে ধূমপানের স্থান। যার মূল উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা এবং সিগারেটকে মানুষের কাছে সহজলভ্য করা। সিগারেট কোম্পানিগুলো টাকা দিয়ে এসব ধূমপানের স্থান করে দেয়। আর মালিকরা টাকার লোভে সেই সুবিধা করে দিচ্ছে। ফলে ধূমপায়ীদের পাশাপাশি অধূমপায়ীরাও এই স্মোকিং জোন থেকে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। একইসঙ্গে রেস্টুরেন্টে এ ধরনের স্মোকিং জোন শুধুমাত্র পরোক্ষ ধূমপানেরই কারণ নয় বরং এর ফলে অগ্নিকান্ডের মতো ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভবনা রয়েছে। অনেক এসি রুমের ভিতরে আছে ধূমপানের কক্ষ।
রেস্টুরেন্টে এসব ধূমপানের স্থান যেনো মরণ ফাঁদ। যে কোন সময় প্রাণ যেতে পারে শত মানুষের। রেস্টুরেন্টে মানুষ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে ও বিনোদনের জন্য যায়, সেখানে ভাল ওয়াশরুম, ছোট লাইব্রেরি, বাচ্চাদের খেলার স্থান, ব্রেস্টফিডিং কর্নার মতো মানসিক ও স্বাস্থ্য সম্মত বিষয়ক রাখা জরুরি। অথচ এসকল গুরুত্বপুর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে সিগারেট কোম্পানির মদদে গড়ে তুলছে ধূমপানে কক্ষ। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে জননিরাপত্তা।
রেষ্টুরেন্ট-এ মানুষ পরিবার নিয়ে খেতে যাবে। কিন্তু সিগারেট কোম্পানি সেখানে তাদের বিষের ব্যবসা শুরু করেছে। সকল পাবলিক প্লেসের ভিতরে ‘‘ধূমপানের স্থান’’ বন্ধের বিধানের বিরুদ্ধে কথা বলতে তারা নানা লোকদের ব্যবহার করেছে। তাদের মধ্যে আছে কিছু রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী।
পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি ঠেকাতে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বিলুপ্ত করতে চাইছে সরকার; এতে করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে সম্পূর্ণ রূপে ধূমপান নিষিদ্ধ হবে।পাশাপাশি আরও কিছু প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু একটি অংশ কঠোরভাবে সরকারের উদ্যোগকে ব্যহত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সিগারেট কোম্পানি নিজের পক্ষে সরকারের বিভিন্ন বিভাগকেও ব্যবহার করছে। যার মধ্যে আছে অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যত জন এসেছে তারা সিগারেট কোম্পানির পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। যেমন ধূমপানমুক্ত স্থান করা যাবে না, ইসিগারেট বন্ধ করা যাবে না, ভ্রাম্যমানভাবে যে কেউ সিগারেট বিক্রি বন্ধ করা যাবে না। তারা বলে সিগারেট ক্ষতিকর কিন্তু তারপরও এসকল কিছু তারা অর্থনীতির জন্য চায়। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যু তাদের গুরুত্বে আসে না। তারা এটা চিন্তা করে কর পাওয়া যাবে, কিন্তু মানুষের জীবন পাওয়া যায় না।
ই-সিগারেট ব্যবহার এ দেশের নেই। কিন্তু ইসিগারেট ধূমপান ত্যাগে সহায়ক বলে ব্যবহার বৃদ্ধিতে চেষ্টা করছে। ইসিগারেট যদি ধূমপান ত্যাগে সহায়ক হয়, তবে যুবকদের নিয়ে ভেপিং মেলা কেন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এ প্রশ্ন সবার করা উচিত। যারা ধূমপান করছে তারা ছেড়ে দিলে নতুন ভোক্তা তৈরির জন্য ই-সিগারেট নিয়ে আসছে। এক সময় প্রচলন ছিল বিদেশী সিগারেট ভাল
এ ক্ষেত্রে অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সকল সময়ের কর্তাব্যক্তিরা সিগারেট কোম্পানির পক্ষে একই অভিন্ন অবস্থান নেয় এবং তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন শক্তিশালী করার বিরোধীতা করে। খুবই অবাক বিষয় এমন ধারাবাহিক মিল দেখে। তবে কারো কারো বিরুদ্ধে সিগারেট কোম্পানি হতে নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা পবার গল্প বাজারে আছে।
নীল চাষ এক অপ্রয়োজনীয় ব্যবসা ছিল। কিন্তু এ দেশের কিছু মানুষের সহযোগিতায় রক্ত ঝড়িয়েও ব্যবসার প্রসার করেছে। লাভ হয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানির, আর ধ্বংশ হয়েছে এ দেশের মানুষ। সিগারেট কোম্পানির ব্যবসার জন্য কিছু মানুষ এখনওতাই করছে। সিগারেট কোম্পানি লাভ নিয়ে যাবে, দেশের জন্য রেখে যাবে রোগ ও মৃত্যু।
অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে দায়িত্ব নেন। সংবিধানে স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে, আপীল বিভাগের রায় আছে তামাক নিয়ন্ত্রণের। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যারা পান তারা সিগারেট কোম্পানির সুরে কোম্পানির পক্ষে অবস্থান নেন। তামাক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না, অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে তামাক নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে। তামাক রাষ্ট্র আর নাগরিদের রক্ষায় অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হয়তো কখনো দেখতে পাব।
লেখক : প্রকল্প কর্মকর্তা, বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি।