ঢাকাশনিবার , ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রেমকাঁটা বা বিঁদির বিলুপ্তি আর প্রাণঘাতি পার্থেনিয়ামের আগমন

রতন মণ্ডল
সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৩ ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ । ১২৩৪ জন

বাংলার পথ-ঘাট হতে প্রেমকাঁটা বা চোরকাঁটা আজ একেবারেই বিলুপ্ত প্রায়।  এটা বাস্তুতন্ত্রের সহায়ক এবং আছে অনেক ভেষজ গুণ। সেই গুণ যুক্ত প্রেমকাঁটা বিলুপ্ত হয়ে অন্যদিকে বাংলাদেশে এসেছে নীরবঘাতক বিষাক্ত আগাছা পার্থেনিয়াম। এর উৎপত্তি মেক্সিকোতে।  কীভাবে বিঁদির বিলুপ্তি আর নীরব ঘাতক পার্থেনিয়ামের আগমন তা পরে বলছি। আগে চোরকাঁটা বিষয়ে একটু জেনে আসা যাক।

বাংলায় চোরকাঁটা/প্রেমকাঁটা এক প্রকার ঘাসের নাম নির্দেশ করে।  এটা জয়পুরহাট, নওগাঁ, বগুড়া, অঞ্চলে বিঁদি নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম- Lovegrass, বৈজ্ঞানিক নাম Andropogon Aciculatus এটি Gramineae পরিবারে একটি উদ্ভিদ। গত ১৫-১৬ বছর আগেও পরিত্যক্ত মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে প্রচুর পরিমাণে জন্মাতো। ৯০ এর দশকে এমন কোনো ছাত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলার উপযোগী করতে প্রেমকাঁটা তুলে পরিস্কার করেনি।

আগের দিনে অনেক জনপ্রিয় গান-কবিতাতেও ইহা স্থান করে নিয়েছে।  বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তম কুমার ও শর্মিলা ঠাকুরের জনপ্রিয় রোমান্টিক গান- ‘যদি হই চোরকাঁটা ঐ শাড়ীর ভাঁজে; দুষ্টু যে হয় এমন কাজ তো তারই সাজে’।  আবার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আমাদের দেশের গান ‘আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায় ধানশালিকের গাঁয়; নাটা বনের চোরাকাঁটা ডেকেছে আমায়’।

তবে মজার বিষয় হলো, প্রভাবশালী এই ঘাস ফসলের মাঠে জন্মাতে দেখা যেত না। পরিত্যক্ত মাঠে কিংবা রাস্তার দুপাশে যেখানে জন্মায়, সেখানে ঘাসের নীচেই মাটিতে বাস করতো প্রচুর কেঁচো।  যে কেঁচোকে প্রকৃতিক লাঙ্গল বলে; যা মাটি নরম ও আর্দ্র রাখে। প্রেমকাঁটার অনেক ঔষধি গুণাবলীও বিদ্যমান- এর মূল ডায়রিয়া প্রশমন করে, বাতের ব্যাথায় এর ব্যবহার রয়েছে, হিন্দুশাস্ত্রে চর্ম রোগে, বেদনা উপশমে, কোষ্ঠ্যপরিস্কারক হিসেবে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

এখন শঙ্কার বিষয় হলো- যেকোনো রাস্তা ঘাটের আশেপাশে তাকালেই এতো পরিমাণ প্রেমকাঁটা দেখা যেতো, আজ তা খুঁজেও পাওয়া যায় না।  কেন আজ বিলুপ্ত? আমরা কি ভেবে দেখেছি? দেশে এ নিয়ে কি গবেষণা হয়েছে? শুধু প্রেমকাঁটা নয়, চেচড়া, মুথা, শ্যামাসহ বাংলার অনেক ঘাসই হারিয়ে গেছে। ইদানীং দূর্বা ঘাসও অনেক কমে গেছে। যে দূর্বা ঘাসের ঔষধি গুণের কথা সবারই জানা। প্রবাদ ছিল এ ঘাস ছয়মাস বাবুইপাখির বাসায় থেকে বৃষ্টি পেলে আবার জীবিত হয়। সেই ঘাসও বিলুপ্ত প্রায়। কিন্তু কেন?

অনেক ভেবে দেখেছি- যখন থেকে আমাদের দেশে আগাছা-নাশক ব্যবহার হতে শুরু হয়েছে তখন থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে এইসব আগাছা। এই আগাছা নাশক ঘাসসহ কতশত গাছগাছালি প্রাণী বিলুপ্ত করে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলেছে তা নিয়ে আমাদের দেশে কখনো বলা হয় না, শোনা যায় না গবেষণার কথাও। বেশকিছু আগাছা নাশক অনেক আগেই উন্নত দেশে নিষিদ্ধ হলেও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত অনুমোদিত।

আবার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গ্লাইফোসেট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক আগে থেকেইএকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করেছে। শ্রীলঙ্কা ২০১৪ সালে, কলম্বিয়া ২০১৫, নেদারল্যান্ড, ফ্রন্স, জার্মানীসহ অনেক দেশ ২০১৭ সালেই নিষিদ্ধ করেছে। অথচ পেস্টিসাইড টেকনিক্যাল এ্যাডভাইসরি কমিটি (PTAC)র সর্বশেষ ৮১তম মিটিং শুধু গ্লাইফোসেট এর ৭২ টি আগাছানাশক অনুমোদন দিয়েছে। তাছাড়া গ্লাইফোসেট এর সাথে ২-৪-ডি সহ অন্যান্য রাসায়নিক সংযুক্ত আরো ২৫-৩০টি অনুমোদিত রয়েছে।

এসব উদ্ভিদ মারার বিষ ব্যবহারে ফসলের ঘাস মারা গেলেও কিন্তু তারপর? জমিতে কি প্রাকৃতিক জৈব সারের যোগান বজায় থাকল কিনা, মাটির অণুজীবের ও কেঁচোর কি ক্ষতি হল, মূল ফসলের কী ক্ষতি হল, অনুখাদ্যের অভাব হবে কিনা, সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে কিনা, ফসলে আগাছানাশক বিষ প্রবেশ করল কিনা। এই বিষের প্রভাবে মানুষ ও পশুপাখির কী কী অসুস্থতা দেখা দেয়, ওই সব রোগের চিকিৎসা ব্যয় বা কত? মাটির গুণগত মান খারাপ হচ্ছে কিনা, বন্ধ্যাত্ব হচ্ছে কিনা? এই প্রশ্নগুলি করেছেন ভারতের কৃষি বিজ্ঞানী ড. অনুপম পাল তার ‘কৃষি ভাবনা ও দুর্ভাবনা’ গ্রন্থে।

এসব নিয়ে উপকরণ বিক্রেতা, যারা বিক্রির অনুমোদন দিলেন, যারা এর সাপক্ষে ব্যবহারের মত দেন এবং কৃষকরাও এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আমাদের বেশ কিছু রাসায়নিক আগাছানাশক চালু আছে। সেগুলি হল- গ্লাইকোসেট, আইসোপ্রটিউরন, পেনডিমেথালিন, ২-৪-ডি, প্যারাকোয়াট। জিরোটিলেজ গম ও ধান ভাবে সুপারিশ করা হয়। এসব তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের চেয়েও ভয়ঙ্কর। উদ্ভিদ মারার বিষ ফসলের নির্দিষ্ট আগাছাকেই মারে না অনেক উপকারী উদ্ভিদকেও হত্যা করে বিলুপ্তি ঘটায়। প্রেমকাঁটা বা বিঁদির বিলুপ্তিই তা সাক্ষ্য দেয়।

এসব বিষ অবশিষ্টাংশ বৃষ্টি, জল,খড়কুটা বিভিন্নভাবে রাস্তায় বা পরিত্যাক্ত মাঠে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রেমকাঁটা,  এতেই চেচড়া, মুথা, দূর্বা, শ্যামাসহ বিলিন হচ্ছে অনেক ঘাস। হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে বিগত কয়েক দশকে এই ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যামেরিকান ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন (ANSF)এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় প্রতিবছর ২০০০ প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতিতে ফাঁকা কোন কিছু থাকে না। এই ফাঁকা স্থান দখল করবে আর এক আগ্রাসী প্রজাতি। প্রেমকাঁটা বা বিঁদির বিলুপ্তিতে যেমন এসছে প্রাণঘাতি আগ্রাসী আগাছা পার্থেনিয়াম।

পার্থেনিয়াম হিসটেরোফোরাস (Parthenium hysterophorus, Asteraceae), প্রচন্ড আগ্রাসী এই গুল্ম জাতীয় গাছটি এখন চাষবাস সমেত স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় বিপদের বার্তা দিচ্ছে। দেখতে কিছুটা গাজরের গাছের মতো। তাই একে গাজর ঘাসও বলে। এর আদত জন্মস্থান মেক্সিকো। আশপাশের সব ছোট গাছকে অবদমিত করে দ্রুত বংশবিস্তারী এই আগাছাকে সবাই পার্থেনিয়াম বা গাজর ঘাস নামে চেনে।

১৯৬০ সালের পর আমেরিকার “পি এল ৪৮০” প্রকল্পে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশকে দান করা খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গম, মাইলো, ভুট্টা দানার সাথে এসেছিল রাশি রাশি পার্থেনিয়াম বীজ। প্রথমে রেল লাইনের ধারে ধারে, পরে গ্রামে শহরের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়ঙ্কর আগাছা। জানা যায় চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর সহ কয়েকটি সীমান্তবর্তী জেলায় রাস্তার ধারে দেখা যায় বছর কয়েক থেকে। আজ সেসব জেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। এমনকি ফসলের মাঠেও দেখা যাচ্ছে মর্মে- খবর প্রকাশিত হচ্ছে। জয়পুরহাট জেলায় জয়পুরহাট-আক্কেলপুর গমনপথে মাতাপুর হতে হালির মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে দেখতে পাই এই আগ্রাসী আগাছা। খুত দ্রুত নিধন করা অবশ্যক। নইলে অচিরেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা জেলায়।

আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)  প্রতিবেদনে বলা হয়- পার্থেনিয়াম দ্বারা সংক্রমিত প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের অবনতি ঘটায়।  এটি আক্রমনাত্মকভাবে বিরক্তিকর স্থানগুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং চারণভূমির বৃদ্ধি এবং এর উৎপাদনকে হ্রাস করে।  এর পরাগ অনেক ফসলে ফলের সেটকে বাধা দেয় বলে জানা যায়। মৌমাছি এর ফুল হতে মৌ বা মধু সংগ্রহ করতেও পারে না। দেশীয় উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম এবং বৃদ্ধি এর অ্যালিলোপ্যাথিক প্রভাব দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। মানুষের মধ্যে, পরাগ শস্য, শুকনো উদ্ভিদের উপাদানের বায়ুবাহিত টুকরো এবং পার্থেনিয়ামের শিকড়গুলি অ্যালার্জির ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যেমন- জ্বর, ফটোডার্মাটাইটিস, হাঁপানি, ত্বকে ফুসকুড়ি, ত্বকের খোসা, ফোলা চোখ, অত্যধিক জল হ্রাস এবং মুখের চুলকানি। এবং নাক, ক্রমাগত কাশি এবং একজিমা। প্রাণীদের মধ্যে, উদ্ভিদ অ্যানোরেক্সিয়া, প্র্যরিটাস, অ্যালোপেসিয়া, ডার্মাটাইটিস এবং ডায়রিয়া হতে পারে।  পার্থেনিয়াম ভেড়ার মাংসকে বিষাক্ত করতে পারে এবং এর বিরক্তিকর গন্ধের কারণে বদহজম ও অস্বস্তিকর করে তুলতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে, পার্থেনিয়ামের কারণে গবাদি পশু শিল্পের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ খরচ এবং চারণভূমির ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়ান ১৬ মিলিয়ন ডলার অনুমান করা হয়েছে।  ভারতে, পার্থেনিয়াম এলার্জি দ্বারা সৃষ্ট আগাছা ডার্মাটাইটিসের একটি ব্যাপক প্রাদুর্ভাবে প্রায় ১,০০০ রোগী এবং কিছু মৃত্যু সহ রিপোর্ট করা হয়েছে।

আমাদের দেশে এর জন্মানোর পরিমান ও প্রভাব আগে থেকে জানা না গেলেও ইদানিং বেশকিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে এসব নিয়ে বিস্তর কোন গবেষণা হয়েছে কি-না জানা যায়নি। আগষ্ট থেকে অক্টোবর পার্থেনিয়ামে ফুল ধরে। এটাই পার্থেনিয়ামকে উপড়ে শুকিয়ে মেরে ফেলার শেষ সময়। এরপর বীজ পেকে গেলে, মূল গাছ উপড়োলোও নতুন চারা বেরিয়ে পার্থেনিয়াম আরও ছড়িয়ে পড়বে। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশকর্মী ও সমাজসচেতন সকলকে একটুও দেরি না করে যত শীঘ্র সম্ভব পার্থেনিয়ামকে নির্মূল করার ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গাছ উপড়ানোর সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

পার্থেনিয়াম বা অন্য কোন আগাছা মারতে কখনোই বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা উচিত না। কেন না- তা পূর্বেই বলেছি। উদ্ভিদ মারার বিষ শুধু কিছু নির্বাচিত উদ্ভিদকেই হত্যা করে না, অনেক বাস্তুতন্ত্রের সাথে সংগতিপূর্ণ উদ্ভিদ, অনুজীব, প্রাণী হত্যা করে। এমনকি মানুষের টিউমার, ক্যান্সার, কিডনী রোগ, বন্ধ্যাত্বসহ অনেক মরণব্যাধী রোগের প্রকোপ সৃষ্টি হবে। এভাবে কৃষি-বিষের ব্যবহার চলতে থাকলে মানুষ নামের প্রজাতিই বিলুপ্ত হবে একদিন।

 

লেখক : ‘দেশীগাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আন্দোলন’ এর উদ্যোক্তা এবং কৃষিবিদ ও কলাম লেখক